সভার আগে সমর্থকদের ‘উৎসব’। নিজস্ব চিত্র
ময়দানে দাঁড় করানো বাসের নীচে ছায়ায় শুয়ে ছিলেন এক ব্যক্তি। বিরক্ত মুখে ঠা ঠা রোদে বেরিয়ে এসে এক মাঝবয়সীকে বললেন, ‘‘একটু ঘুমোতে দেবে? কাল রাতে বাসে তুলেছ। সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে দাওনি। এখন এ সব গান বাজানোর কী দরকার! একটু ঘুমোতে দাও ভাই।’’ এ সব কথায় অবশ্য ভ্রূক্ষেপ নেই মাঝবয়সীর। মাথায় ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’ লেখা টুপি পরে গানের তালে নাচতেই ব্যস্ত তিনি। আপত্তি শুনে থামার বদলে বাসে লাগানো বক্সের আওয়াজ আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে নাচতে শুরু করলেন।
এগিয়ে দেখা গেল, দলীয় পতাকা লাগানো বাস-লরির ছায়ায় বসে আড্ডায় মেতেছেন একদল যুবক। নির্দ্বিধায় খুলে বসেছেন নেশার সামগ্রী! এগুলো কী? প্রশ্ন করায় হাসি হাসি মুখ করে তাঁদের এক জন বললেন, ‘‘এটা হয়তো উচিত না। কিন্তু কলকাতায় এসেছি, একটু উৎসব করব না?’’
বিজেপি-র সভা ঘিরে বুধবার এমনই নানা দৃশ্য দেখা গেল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড এবং সেই সংলগ্ন ময়দান এলাকায়। এ দিনেরটা ধরলে ব্রিগেডে গত চার মাসে সভা হল তিনটি। বাম ও তৃণমূলের পরে এ দিন ছিল খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভা। তবে দৃশ্যগত ভাবে আগের দু’টির সঙ্গে এ দিনের জনসভার কোনও পার্থক্য করা গেল না। একই ভাবে কলকাতার ফুসফুস বলে পরিচিত ময়দান এলাকা কাঁপিয়ে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত চলল মাইকের তাণ্ডব। ধর্মতলা মোড়ে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট শোনা গেল বক্তৃতা। যেখানে সেখানে গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না হল ময়দানে। খাওয়া শেষে প্লাস্টিক, কাগজের স্তূপও পড়ে থাকল ময়দান জুড়ে। মূল মঞ্চের কাছেও দেদার বিলোনো হল খাবারের প্যাকেট। সভা শেষে তা-ও পড়ে থাকল। পুরনো দৃশ্য মনে করিয়ে অনেকেই আবার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে শৌচকর্ম সারতে দখল নিলেন ময়দানের ঝোপঝাড়ের। কাউকে আসতে দেখলেই চেঁচাতে শুরু করলেন, ‘জয় শ্রীরাম!’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
চেনা দৃশ্য দেখা গেল রেড রোড ও সংলগ্ন রাস্তাগুলিতেও। হেলমেটহীন বেপরোয়া মোটরবাইক আরোহীরা দাপিয়ে বেড়ালেন দলীয় পতাকা বাইকে লাগিয়ে। পুলিশ তখন নীরব দর্শক। রেড রোড দিয়ে যাওয়ার সময়ে ওই বাইক বাহিনীই স্লোগানে নিশানা করল পুলিশকে। কর্তব্যরত ট্র্যাফিক আধিকারিক বললেন, ‘‘কী বলব? আজ ওদের দিন। যা পারে করুক!’’ এই ‘যা ইচ্ছে’ করার নমুনা দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী পৌঁছনোর ঘণ্টাখানেক আগে। রেড রোডে আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য দাঁড় করানো অ্যাম্বুল্যান্সের চালকের দরজা খুলে উঠে দাঁড়িয়ে এক জন স্লোগান তুললেন, ‘‘মোদীর জয়।’’ তাঁকে টেনে নামিয়ে তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করল পুলিশ।
প্রধানমন্ত্রীর সভা ঘিরে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল ব্রিগেডে। মোদীর জন্য থাকা ‘স্পেশ্যাল প্রোটেকশন গ্রুপ’ (এসপিজি)-এর পাশাপাশি সাধারণের জন্য এ বারই প্রথম মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ব্রিগেডে। সভায় ঢোকার মোট ছ’টি গেটে এমন ডিটেক্টর বসানো হয়েছিল। তবে বেলা বাড়তে সেই মেটাল ডিটেক্টর এড়াতে সভাস্থল ঘিরতে ব্যবহৃত গেরুয়া কাপড় ছিঁড়ে ঢুকতে শুরু করলেন অনেকে। গেটের সামনে তখন স্রেফ পড়ে রইল প্রচুর দেশলাইয়ের বাক্স। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক আধিকারিক বললেন, ‘‘দেশলাই নিয়ে সভায় ঢুকতে দিতে পারি না। কিন্তু অনেকেই জেদ ধরছেন, দেশলাই ছাড়া যাবেন না। তাঁরাই ওই কাপড় ছিঁড়ে ঢুকেছেন।’’
জয়প্রকাশ সাউ। ছবি: মেহবুব কাদের চৌধুরী
এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্যই সভায় ঢুকতে পারছিলেন না বারাসত থেকে আসা জয়প্রকাশ সাউ। প্রতিবন্ধী জয়প্রকাশ পেশায় রিকশাচালক। স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়া, বোন মীনাদেবী এবং চার বছরের মেয়েকে রিকশায় বসিয়ে সভায় এসেছিলেন তিনি। জেদ ধরেছিলেন, রিকশা নিয়েই সভায় ঢুকবেন। তাঁর কথায়, ‘‘বারাসত থেকে রিকশা চালিয়ে এসেছি। রিকশা নিয়েই সভায় যাব। আমরা চৌকিদার। পুলিশ কী করে আটকায় দেখি!’’
শেষে অবশ্য রিকশা বাইরে রেখেই সভায় ঢুকতে হয়েছে তাঁকে। ‘চৌকিদারের আশা’ পূরণ হয়নি। ঠিক যে ভাবে শ্রী ফেরেনি ব্রিগেড সভার!
অন্য দিকে, এ দিন বিজেপি-র মিছিলে অস্ত্র নিয়ে আসার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করতে চলেছে পুলিশ। মুরলীধর সেন লেনের কাছে একটি মিছিলে ত্রিশূল দেখা গিয়েছে বলে অভিযোগ। কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (১) জাভেদ শামিম বলেন, ‘‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ এর পাশাপাশি পুলিশ জানিয়েছে, সভায় আসা এক ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়ায় পুলিশের গাড়িতেই তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে পাঠানো হয়।