‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’

‘এই শহরে প্রবীণেরা কতটা সুরক্ষিত?’ সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকা আয়োজিত ‘শহর কী বলছে’ শীর্ষক আলোচনায় এই প্রশ্নই রাখা হয়েছিল বৈষ্ণবঘাটা পাটুলি টাউনশিপ এবং সিঁথি বিধান পার্কের বাসিন্দাদের সামনে। নিরাপত্তাহীনতার দগদগে অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা শুভব্রত ছাড়াও পাটুলির আলোচনায় ছিলেন কলকাতা কমিউনিটি পুলিশের আধিকারিক তথা বয়স্কদের জন্য শুরু করা কলকাতা পুলিশের ‘প্রণাম’ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:৫৩
Share:

আলোচনা: প্রবীণদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আলোচনাসভায় স্থানীয়েরা। (

আমাদের মধ্যে কেউ একটা সে দিন বাড়িতে থাকলে হয়তো মাকে এ ভাবে মরতে হত না!

Advertisement

কথাটা শুনেই শিরদাঁড়া সোজা করে বসলেন অনেকে। চলতে থাকা ফিসফাস মুহূর্তে উধাও। বেহালার বাড়িতে একা থাকাকালীন খুন হওয়া বৃদ্ধা শুভ্রা ঘোষের পুত্র শুভব্রতই ফের কথা শুরু করে বললেন, ‘‘কাজে তো যেতেই হবে। একা বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মাকে রেখে বেরোলে কি তাঁরা নিরাপদে থাকতে পারবেন না? আমিও উত্তর খুঁজছি।’’

‘এই শহরে প্রবীণেরা কতটা সুরক্ষিত?’ সম্প্রতি আনন্দবাজার পত্রিকা আয়োজিত ‘শহর কী বলছে’ শীর্ষক আলোচনায় এই প্রশ্নই রাখা হয়েছিল বৈষ্ণবঘাটা পাটুলি টাউনশিপ এবং সিঁথি বিধান পার্কের বাসিন্দাদের সামনে। নিরাপত্তাহীনতার দগদগে অভিজ্ঞতা নিয়ে আসা শুভব্রত ছাড়াও পাটুলির আলোচনায় ছিলেন কলকাতা কমিউনিটি পুলিশের আধিকারিক তথা বয়স্কদের জন্য শুরু করা কলকাতা পুলিশের ‘প্রণাম’ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ছাড়াও ছিলেন স্থানীয় থানার ওসি সৌম্য ঠাকুর। সত্যজিৎবাবু ছিলেন সিঁথির আলোচনাতেও। এ ছাড়াও সেখানে যোগ দিয়েছিলেন মনোবিদ মোহিত রণদীপ। ফোনে যোগাযোগ করা গিয়েছিল বাবা-মাকে কলকাতায় রেখে কাজের সূত্রে বিদেশে থাকা কয়েক জন সন্তানের সঙ্গেও। বয়স্কদের নানা পাওয়া-না পাওয়ার দাঁড়িপাল্লায় আলোচনা চললেও একটা বিষয়ে সকলেই একমত, বয়স্কদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে, আইনের সুরক্ষাতেও কাজ হবে না।

Advertisement

পাটুলির অঞ্জনকুমার সিংহ যেমন বলছিলেন, ‘‘বহু দিন এই পাড়ায় রয়েছি। বয়স হয়েছে। সকলেই আইনের সুরক্ষার কথা বলছেন, আমাদের তো সামাজিক সুরক্ষাই নেই!’’ একই কথা সিঁথির সুভাষচন্দ্র মজুমদারের, ‘‘আমরা দুই, আমাদের এক। ছোট পরিবারের একাকিত্বই বয়স্কদের বড় সমস্যা। আমরা বাড়ির বাইরেও আক্রান্ত হচ্ছি, ভিতরেও। সবার আগে সামাজিক সুরক্ষা প্রয়োজন।’’ এই প্রেক্ষিতেই মোহিতবাবুর প্রশ্ন, ‘‘শিক্ষায় কি ফাঁক থাকছে? নতুন প্রজন্ম কি দায়িত্ব নিতে শিখছে না? শিখলে এই সামাজিক নিরাপত্তার অভাব কেন?’’ গত কয়েক বছরে কলকাতায় একের পর এক বয়স্ক খুনের প্রসঙ্গ টেনে সিঁথির সুনীলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বয়স্কদের এ বার সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে।’’

উপস্থিত সকলকে আশ্বস্ত করে পুলিশ আধিকারিক সত্যজিৎবাবু জানান, প্রণাম প্রকল্পের কথা। জানান, অচেনা কোনও মিস্ত্রিকে নিজের বাড়িতে কাজ করতে দেওয়ার আগে তাঁর পরিচয়পত্র নিয়ে থানায় জানিয়ে রাখার কথা। তিনি বলছিলেন, ‘‘পুলিশি নজরদারি পাড়ায় পাড়ায় অনেক বেড়েছে। বাড়িতে কাজ করানোর আগে মিস্ত্রির সচিত্র পরিচয়পত্র থানায় দিয়ে রাখুন। রাতে ঘুমনোর আগে অন্তত একটা আলো জ্বালানো থাক। যে কোনও সমস্যায় পড়লেই মনে রাখুন, ১০০ নম্বরটা খোলা আছে। সাহায্য মিলবেই।’’

পাটুলির প্রদীপকুমার বসুর অবশ্য অভিজ্ঞতা, পুলিশকে সমস্যার কথা জানানোর পাঁচ দিন পরেও থানা থেকে কেউ আসেননি। তাঁর কথায়, ‘‘ছেলে বেঙ্গালুরুতে থাকে। আমি আর আমার স্ত্রী এখানে সত্যিই অরক্ষিত বোধ করি।’’ পাটুলিরই বাসিন্দা নির্মল ঘোষদস্তিদার আবার বললেন, ‘‘পুলিশকে দেওয়া তো দূর, আমরা চাইলেই বাড়ির কাজের লোক পরিচয়পত্র দেন না। মোবাইলে ছবি তুলতে গেলে বলেন, কাজ ছেড়ে দেব।’’ তাঁর পরামর্শ, পুলিশই বয়স্কদের জন্য কল, আলো বা রাজমিস্ত্রির নাম রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করুক। তাতেই থাকুক গৃহস্থালির কাজের লোকের নাম এবং ফোন নম্বর।

তবু ঘুরপাক খাচ্ছিল কানাডা থেকে ফোনে সিঁথির আলোচনায় যোগ দেওয়া দেবারতি ভট্টাচার্যের প্রশ্ন। ‘‘বাবা-মা কলকাতায়। চিন্তা তো যায় না, এত কিছুর পরেও কি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে?’’

মোহিতবাবু বললেন, ‘‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি। ওইটাই একমাত্র পথ।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement