বিপুল ক্ষতি, তবু বিদ্যুৎ চুরি ঠেকাবে কে

রাস্তার পাশে সার দেওয়া মাংসের দোকান। সেখানে লোহার আঁকশিতে ঝুলছে কেটে রাখা বড় বড় মাংস। সারা রাত ধরে বড় বড় পাখা চালিয়ে, ২০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে সেই মাংস শুকোনোর কাজ চলছে।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৬ ০১:০৩
Share:

এ ভাবেই অবাধে চলছে হুকিং। —নিজস্ব চিত্র।

রাস্তার পাশে সার দেওয়া মাংসের দোকান। সেখানে লোহার আঁকশিতে ঝুলছে কেটে রাখা বড় বড় মাংস। সারা রাত ধরে বড় বড় পাখা চালিয়ে, ২০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে সেই মাংস শুকোনোর কাজ চলছে।

Advertisement

সরু গলি। অনেক জায়গাতেই আকাশ দেখা যায় না তারের জালে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছে সেই তার। রাস্তার আলোকস্তম্ভের বক্স থেকে সরাসরি নেওয়া হয়েছে বিদ্যুৎ। সেই বিদ্যুৎই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে বস্তির ঘরে।

বাড়িতে বাড়িতে এসি। কিন্তু তার জন্য আলাদা মিটার কই? দু’টি পয়েন্টের জন্য নেওয়া মিটার নিয়েই দিব্যি চলছে টিভি, এসি, মাইক্রোওভেন।

Advertisement

বন্দর এলাকার মহল্লা-মহল্লায় ঘুরলেই এই দৃশ্য চোখে পড়বে। তার জন্য সিইএসসি-র অফিসার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রয়োজন নেই। সিইএসসি-র পরিদর্শক দল এলাকায় যে যায় না তা নয়। কিন্তু বেআইনি বিদ্যুৎ সংযোগ কখনও কাটা হয় বলে কেউ শোনেনি। যদিও সংস্থার কর্তাদের একাংশের দাবি, কোথাও হুকিং চোখে পড়লে তা সঙ্গে সঙ্গে খুলে দেওয়া হয়।

সূত্রের খবর, বন্দর এলাকা ছাড়াও কামারহাটি, রাজাবাজার, এন্টালি, চিৎপুর-কাশীপুর, তপসিয়া-তিলজলা, টিটাগড়, পিলখানা-সহ কলকাতা, হাওড়া, উত্তর শহরতলিতে বিদ্যুৎ চুরির জন্য প্রতি বছর সিইএসসি-র প্রায় ২০০ কোটি টাকা করে লোকসান হচ্ছে।

সিইএসসি-র নিজস্ব হিসেব অনুযায়ী, বিদ্যুৎ চুরির জন্য শুধু তিলজলাতেই মাসে লোকসান প্রায় ৩-৪ কোটি টাকা! একবালপুর-মোমিনপুর-খিদিরপুর-গার্ডেনরিচ-মেটিয়াবুরুজেও অঙ্কটা প্রায় একই। সিইএসসি-র লস কন্ট্রোল সেল (লোকসান নিয়ন্ত্রণ বিভাগ)-এর জিএম সৌমিত্র ঘোষের কথায়, ‘‘নিয়মিত অভিযানে হুকিং বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। তবুও প্রতি বছর লোকসান ঠেকানো যাচ্ছে না।’’

কী ভাবে চলছে বিদ্যুৎ চুরি? সিইএসসি সূত্রে খবর, মিটার রিডিংয়ের ব্যাপার নেই। ভাড়া দেওয়া হচ্ছে চুরি করা বিদ্যুৎ। একটি ঘরে দু’টি আলো, একটি পাখা, টিভি— ভাড়া মাসে ২০০ টাকা। দোতলা বাড়ি। সঙ্গে এসি-ফ্রিজ-ওয়াশিং মেশিন থাকলে ভাড়া ৫০০ টাকা। মাসে ওই টাকাটা দিলে যতক্ষণ খুশি চালানো যাবে আলো-পাখা।

এলাকায় তবে কি কোনও বাড়িতেই মিটার নেই? আছে। সিইএসসি সূত্রের খবর, কিছু বাসিন্দার নামে মিটার আছে। সেই মিটারে বড়জোর একটি আলো, একটি পাখা চলছে। বাকি সব চলে বেআইনি বিদ্যুতে ভরসা করেই।

হুকিংয়ের প্রতিবাদ করায় গত শুক্রবার পিটিয়ে মারা হয়েছে মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দা নজরুল ইসলামকে। অভিযোগ, বছরের পর বছর এই বিদ্যুৎ চুরির কথা মন্ত্রী-সান্ত্রী থেকে পুলিশ কর্তা সবাই জানা সত্ত্বেও কেউ কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

পুলিশ জানায়, বিদ্যুৎ চুরি আর ব্যক্তিগত স্তরে আটকে নেই। প্রতি এলাকায় একটি চক্র রয়েছে। একদল যুবক থাকেন, যাঁরা ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। তাঁরা সিইএসসি-র প্লাস্টিক মোড়া শক্ত তার কেটে বাইরের তার জুড়ে দেন। পুরো কারবারটা চলে এলাকার ‘দাদাদের’ তত্ত্বাবধানে। তারাই বাড়ি বাড়ি টাকা তোলে। সেই টাকা সমাজের বিভিন্ন স্তরে পৌঁছে দেয়। এ ভাবে হুকিং থেকে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা রোজগার!

২০১১-এ মগরাহাটে হুকিংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ পর্ষদ অভিযান চালানোর সময়ে গোলমালে পুলিশ গুলি চালালে এক মহিলা ও এক বালিকা মারা যায়। তার পর থেকে হুকিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান কমে যায়। যদিও সৌমিত্রবাবুর দাবি, এখনও তাঁদের অফিসারেরা অভিযান চালান। কখনও সঙ্গে পুলিশ থাকে। কখনও থাকে না। এলাকায় এলাকায় অভিযান চালাতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় তাঁদেরও। যেখানে যেখানে হুকিং চোখে পড়ে, তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে তা খুলে ফেলেন।

কিন্তু বাহিনী ফিরলেই আবার যে কে সেই। চুরি করা বিদ্যুতেই চলে সব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন