স্ত্রী-র স্মৃতি ফেরাতে ৫৫ বছর পর ফের ছাদনাতলায়

সাত বছর হল ডিমেনশিয়া অর্থাৎ স্মৃতিভ্রং‌শ হয়েছে কনের। এত বছরের সংসারের সুখ-দুঃখের অধিকাংশ কথাই মুছে গিয়েছে ৮১ বছরের বৃদ্ধার স্মৃতি থেকে। সেই রোগ-শত্রুর সঙ্গে লড়াই জারি রেখেছেন বছর ৮৩-র বৃদ্ধ বর।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:০৬
Share:

অটুট: বিয়ের আসরে পবিত্রচিত্তবাবু ও গীতাদেবী। রবিবার দুপুরে, দমদম ক্যান্টনমেন্টে। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

নতুন শাড়ি, সোনার গয়নায় সাজানো হয়েছে কনেকে। কর্তার পরনে নতুন পাজামা-পঞ্জাবি। ক্লান্ত কনে, অস্ফুটে কিছু বলে চলেছেন। টেনে খুলে নিচ্ছেন মাথার ক্লিপগুলো। কর্তাটি তাঁকে দু’হাতে স্নেহের আগলে চেপে ধরে ‘সোনা মেয়ে’, ‘লক্ষ্মী মেয়ে’ বলে বসিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন। এরই মধ্যে সারা হল মালাবদল, সিঁদুরদান। পঞ্চান্ন বছর পরে, দ্বিতীয় বার!

Advertisement

সাত বছর হল ডিমেনশিয়া অর্থাৎ স্মৃতিভ্রং‌শ হয়েছে কনের। এত বছরের সংসারের সুখ-দুঃখের অধিকাংশ কথাই মুছে গিয়েছে ৮১ বছরের বৃদ্ধার স্মৃতি থেকে। সেই রোগ-শত্রুর সঙ্গে লড়াই জারি রেখেছেন বছর ৮৩-র বৃদ্ধ বর। রবিবার দমদম ক্যান্টনমেন্টে নিজেদের বাড়িতে এই বিয়ের আসরও সেই লড়াইয়েরই অংশ। অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক স্ত্রী গীতা নন্দীর স্মৃতি ফিরিয়ে আনতেই সাত পাকে বাঁধা পড়ার ‘রিপিট টেলিকাস্ট’ আয়োজন করেন বৃদ্ধ পবিত্রচিত্ত নন্দী। ভালবাসার সেই চেষ্টার সাক্ষী থাকল সংবাদমাধ্যম এবং দুশো জন নিমন্ত্রিত অতিথি। ফিশ ফ্রাই, পোলাও, চিংড়ির ভোজে বসে তাঁদেরই অনেকে বললেন, এ যেন ঠিক নিকোলাস স্পার্কসের প্রেমের গল্পের মতো। ‘নোটবুক’ নামের সেই গল্পে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত বৃদ্ধা অ্যালির স্মৃতি ফেরাতে স্বামী নোয়া লিখে ফেলেছিলেন নিজেদেরই প্রেম ও সংসারের গল্প। একটি হোমে সেই নোটবুক রোজ পড়ে শোনানো হত অ্যালিকে। স্মৃতি না ফিরলেও সেই গল্প শুনেই কিছুটা চাঙ্গা থাকতেন বৃদ্ধা।

কেমন আছেন এই গল্পের অ্যালি?

Advertisement

সাত বছর আগেও সব ছিল স্বাভাবিক। হঠাৎই বদলাল এই গল্পের মোড়ও। পবিত্রচিত্তবাবু বলেন, ‘‘কিছু অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যাচ্ছিল। যেমন বাথরুমে যাচ্ছি বলে, সোজা চলে গেলেন রান্নাঘরে। প্রথম দু’বছর মানসিক রোগের চিকিৎসা চলে। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় এক বন্ধু চিকিৎসকের পরামর্শে মস্তিষ্কের স্ক্যান করানো হয়। তখনই ধরা পড়ে অ্যালঝাইমার্সে আক্রান্ত গীতা।’’ এখন অন্যের সাহায্য নিয়ে হাঁটতে হয় তাঁকে। বন্ধ হয়ে গিয়েছে কথা। শুধু নিশ্চিন্তের আশ্রয় মনে করেন পঞ্চান্ন বছরের এই সঙ্গীকে, যিনি আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের পাশে রয়েছেন সর্বক্ষণের সঙ্গী পুষ্পও।

স্নায়ুরোগের চিকিৎসক তৃষিত রায় বলেন, ‘‘ডিজেনারেটিভ ডিমেনশিয়া অর্থাৎ, অ্যালঝাইমার্সের চিকিৎসা সে অর্থে নেই। ওষুধে কিছুটা মন্থর হয় এই রোগের প্রকোপ। তবে মূল প্রয়োজন হল ‘কেয়ার গিভার’। সে কাজটাই করে চলেছেন পবিত্রচিত্তবাবু। তাঁর কাজটা খুবই কঠিন। এই বয়সে তো আরও। জীবনের ছন্দ ভুলে যাওয়া এক জন মানুষের সঙ্গে লেগে থাকাতে অসীম ধৈর্যের প্রয়োজন।’’ তাঁর মতে, শুধু এমআরআই-এ অসুখ ধরা পড়ে না। নির্ণয়ের জন্য বেশ কিছু সাইকোমেট্রি টেস্ট করাতে হয়। অতিরিক্ত অবসাদ রোগের একটা কারণ। ফলে অনেকেই মনে করেন, রোগীকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করা প্রয়োজন।

সবচেয়ে আনন্দের একটি মুহূর্তই তাই স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছেন পবিত্রচিত্তবাবু। সালটা ছিল ১৯৬৩। জানুয়ারি মাস। শুধু পাত্রের পরিবারের মত নিয়েই বিয়েটা সেরে ফেলার কথা ঠিক করেছিলেন দু’জনে। বন্ধুত্বটা তারও বেশ কিছু দিন আগে থেকেই। পবিত্রচিত্তবাবু তখন বছর আঠাশের যুবক, আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজের বোটানির শিক্ষক। গীতা তাঁরই ছাত্রী। তখন বিএসসি পড়ছেন। খুলনার বাসিন্দা গীতা তখন সুকিয়া স্ট্রিটে বড় দিদি-জামাইবাবুর বাড়িতে থাকেন। বিয়ের কথা উঠতেই মেয়ের রক্ষণশীল পরিবার থেকে বাধা আসে। কিন্তু গীতাদেবীকে কাছে টেনে নেন পবিত্রবাবুর পরিবার। বিয়ের পরে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে শিয়ালদহ বি আর সিংহ হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন গীতাদেবী। বছর কুড়ি আগে দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদও হয়েছিলেন তিনি।

নিঃসন্তান দম্পতি বছর কয়েক আগে একটি ট্রাস্ট তৈরি করেন। দরিদ্র এবং মেধাবী পরিবারের অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের নিখরচায় পড়াবে এই ট্রাস্ট। সে কাজের শুরু হবে নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকেই। সম্প্রতি দক্ষিণ সুভাষনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রায় ন’লক্ষ টাকা খরচ করে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কক্ষ এবং একটি পাঠাগার তৈরি করে দিয়েছেন নন্দী-গুহর জীবনবিজ্ঞান মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের লেখক পবিত্রচিত্ত নন্দী। এ সব কাজেই গীতাদেবীর ভরপুর উৎসাহ ছিল বলে জানালেন তাঁর ভাইপো।

হইচইয়ের ফাঁকে নন্দীবাবু জানালেন, ডিমেনশিয়ার চিকিৎসা নেই। চিকিৎসকেরা সে কথা বলেও দিয়েছেন। ‘‘তবু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী! একটাই প্রার্থনা, ওঁর শেষ দিন পর্যন্ত যেন এ ভাবেই যত্ন নিয়ে যেতে পারি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন