‘ফাঁকিবাজি’তে তৃপ্ত শহরের হালিম-প্রেম

এক বাক্স কমলা-হলুদ আতরগন্ধী শুকনো ভাতে হাড়সর্বস্ব মাংসের টুকরোটা দেখে কোনও কোনও ভোজনরসিক তিতিবিরক্ত।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৮ ০২:৫১
Share:

খানাখাজানা: মল্লিকবাজারে দেদার বিকোচ্ছে হালিম। নিজস্ব চিত্র

কলকাতার বিরিয়ানি নিয়ে বাঙালি যতই আদিখ্যেতা করুক, অভিযোগেরও কিন্তু অন্ত নেই!

Advertisement

এক বাক্স কমলা-হলুদ আতরগন্ধী শুকনো ভাতে হাড়সর্বস্ব মাংসের টুকরোটা দেখে কোনও কোনও ভোজনরসিক তিতিবিরক্ত। বিরিয়ানির আলুর প্রতি যতই দুর্বলতা থাক, মাংসের অভাবে শুধু প্রকাণ্ড আলুর উপস্থিতিতে মন ভোলানোটাও অনেকেই মেনে নেবেন না। একই কথা রমজানি হালিম নিয়েও খাটে। হালিম তো নয়, একটু ঘন থকথকে ডালে কয়েক টুকরো মাংসের বদান্যতা! কারও কারও মত, একে হালিম না বলে ডালগোস্ত বলাই জায়েজ়। শহরের চিরকেলে মুসলিম মহল্লাগুলোর চৌহদ্দি ছাড়িয়ে হালিম যতই উত্তরে-দক্ষিণে ভেতো বাঙালি মহল্লায় হানা দিচ্ছে, ততই জোরালো হচ্ছে হালিমের জাত খোয়ানোর অভিযোগ। সেই সঙ্গে হায়দরাবাদের হালিমের সঙ্গে বিঁধছে তুলনার কাঁটা।

কাঁকুড়গাছির পূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন প্রতি রমজানে ক্যুরিয়রে হায়দরাবাদ থেকে কয়েক কেজি হালিম অর্ডার দেন। গুগল করলেই মালুম হবে, অনলাইন হালিম প্রসারের নিরিখেও হায়দরাবাদের কাছে দশ গোল খাবে কলকাতা। অর্ডার দেওয়ার দু’দিনেই জবরদস্ত টিনবন্দি হয়ে হায়দরাবাদের পিস্তা হাউসের হালিম হাজির হবে আপনার কলকাতার বাড়ির দোরগোড়ায়।

Advertisement

দুই ঘরানার ফারাকটাও চাখলেই জলের মতো পরিষ্কার। কলকাতার হালিম কিছুটা মাংসভরা সুপের মতো। হাড়সুদ্ধ বা হাড়বিহীন মাংসের টুকরো সেই সুপে ডুবে থাকে। এর তুলনায় হায়দরাবাদি হালিম ঢের গাঢ়। থকথকে মোটা পুরে ডাল-মাংস একাকার। এখনকার কলকাতার হালিম উন্মাদনা কিন্তু লখনউকেও টেক্কা দেবে বলে মনে করেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের পরিবারের মেয়ে মনজিলাৎ বেগম। তবে কলকাতার গড়পড়তা হালিম নিয়ে অভিযোগও রয়েছে রন্ধনপটিয়সী মনজিলাতের। তাঁর মতে, ‘‘লোকে রুটি-পরোটা দিয়ে মেখে হালিম খাচ্ছে দেখলে অসহ্য লাগে। আমাদের বাড়ির খানদানি হালিম, বিরিয়ানির মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ। মাংস-ডালের মিশেলে থকথকে খিচুড়ি বা রিসোত্তোর মতো।’’

মল্লিকবাজারের সিরাজ বা পার্ক সার্কাসের আফজ়ায় এখন কলকাতার চেনা হালিমের সঙ্গে হায়দরাবাদি হালিমও কিন্তু জায়গা করে নিয়েছে। সিরাজের কর্ণধার ইশতিয়াক আহমেদ বলছেন, ‘‘শহরের হালিমভক্তদের অভিজ্ঞতার পরিধি বেড়েছে। অনেকে হালিমে অন্য স্বাদ খোঁজেন বলেই হায়দরাবাদি ঘরানাকেও আমরা ঠাঁই দিয়েছি।’’ তবে ইশতিয়াক সাহেবের দাবি, তাঁর রেস্তোরাঁয় শাহি হালিমের চাহিদা এখনও হায়দরাবাদি হালিমের তুলনায় চার গুণ বেশি।

কেন? কারও কারও মত, হায়দরাবাদি হালিমের মশলার গন্ধ সব সময়ে কলকাত্তাইয়াদের জিভে পোষায় না। তা ছাড়া, বিরিয়ানির ভাতে মাংসের ঝোল বা কাই মেখে খাওয়ার মতো হালিমের অনুষঙ্গেও কলকাতার লোক একটু রুটি-পরোটা খেতে ভালবাসেন! কিন্তু নিজেদের শাহি হালিমের ‘হালিমত্ব’ নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ইশতিয়াক। তবে তিনিও বলছেন, ‘‘নাম করা ঠিক নয়, কলকাতার রমজানে কয়েকটি জায়গায় হালিম একেবারেই ডালগোস্তের গোত্রে নেমে এসেছে! এটা দুঃখের।’’

হালিমরসিকদের কারও কারও মত, মাংসের ভাগটা হায়দরাবাদি হালিমেই সুনিশ্চিত। প্রতি চামচেই থকথকে পুরের আধারে মাংস থাকবে। সেখানে কলকাতার হালিমে ইদানীং ডালের সুপে হাড় জিরজিরে মাংসের ছায়া খুঁজতেও হা-পিত্যেশ করতে হয়। আজকের বাঙালি কাজের সূত্রে হায়দরাবাদ চেনে বলে আসল হালিমের মর্ম বুঝতে শিখছে। ইশতিয়াক সাহেব বা মনজিলাতের মতো হালিম বিশারদেরা অবশ্য বলছেন, সব হালিম সমান নয়। যত্ন করে রাঁধলে কলকাতার চেনা হালিমে এক কেজি ডালে, চার কেজি মাংস থাকবেই। মাংসের কোফতা বা বোটির প্রাচুর্য মিশে থাকবে থকথকে সুপে। চাইলে ফাঁকিবাজি কিন্তু হায়দরাবাদি হালিমেও ঘটতে পারে। হায়দরাবাদি ঘরানায় ডাল-মাংসের থকথকে পুরে মাংসের ভাগ কম রেখে ঠকানোও অসম্ভব নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন