ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
কেউ কুড়ি পেরিয়েছে। কারও বয়স সবে আট। বয়সের হেরফের হলেও কোনও ঝুঁকি নেই। নেই উটকো ঝামেলাও। শর্ত একটাই, হাজার অসুবিধা হলেও মিটিং-মিছিলে যেতে হবে দল বেঁধে। এই শর্তে বছরের পর বছর ধরে শিয়ালদহ উড়ালপুলের নীচের ফুটপাথ জুড়ে রমরমিয়ে চলছে দোকান। তেলেভাজা থেকে সব্জি, ফল থেকে জুতো— কী নেই পসরায়! নেই বলতে শুধু আইনি বৈধতাটুকুই। মানছেন বিক্রেতারাই।
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে বেরিয়েই হাতের কাছে সারি সারি দোকান। সংখ্যাটা প্রায় হাজার ছাড়িয়েছে। শিশির মার্কেটের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডের ফুটপাথ জুড়ে থাকা এগরোল, চাউমিন, ফল ও জুতোর দোকান। খাতায় কলমে এই দোকানিরা মার্কেটের আওতায় নন। কোনও কারণে শিশির মার্কেট বন্ধ থাকলেও ঝাঁপ খোলা থাকে তাদের। কারণ দোকানিরা সকলেই হকার্স ইউনিয়নের সদস্য। সংগঠনের ছাতাই শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় রক্ষা করে। এমনই এক এগরোল-চাউমিন বিক্রেতা মহিন্দর সাউ প্রায় বুক ঠুকেই বললেন, ‘‘সবচেয়ে পুরনো আমার দোকান। আইনের ছাড় না থাকলেও সংগঠন আমার সঙ্গে রয়েছে। গোটা ফুটপাথ জুড়েই থাকতাম। এখন লোক বাড়তে থাকায় দোকানের অংশ ছোট হয়ে যাচ্ছে।’’
মহিন্দর জানান, প্রায় কুড়ি বছর আগে বাম আমলে আগরপাড়া থেকে এক বন্ধুর সূত্রে শিয়ালদহ চত্বরের এক বাম নেতাকে ধরে ফুটপাথে বসার অনুমোদন পেয়েছিলেন তিনি। এর পরে বামেদের দখলে থাকা হকার্স ইউনিয়নের সদস্য হয়ে দোকানের কাজ শুরু। মহিন্দারের কথায়, ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরে উড়ালপুলের নীচের ওই ফুটপাথে ভাগ বসাতে
থাকে আরও কয়েক জন। হকার্স ইউনিয়নও রাতারাতি চলে যায় তৃণমূলের দখলে। পাশে গজিয়ে ওঠে আরও তিনটি দোকান।
দোকান ফুটপাথে হলেও বেশির ভাগ সরঞ্জাম চলে এসেছে রাস্তার উপরে। তাদের দাপটে পথচলাই দায়। প্রতিদিন সকালে পুরসভার সাফাইকর্মী পরিষ্কার করতে গেলে খুশি হয়ে দশ টাকা বাড়তি দেন অনেকেই। কিন্তু পথচলতি মানুষের যে অসুবিধা হয়। তা সত্ত্বেও কী ভাবে চলছে দোকান? একগাল হেসে মহিন্দর বলেন, ‘‘খিদের সময়ে হাতের কাছে খাবার পান সকলেই। এতে তো সুবিধা বেশি। যত বেশি দোকান, তত বেশি প্রতিযোগিতা। তাতে খাবারের মান ভাল হয়।’’ বর্তমানে লোক দিয়ে দোকান চালাতে হয়। উল্টো দিকের ফুটপাথে ফের জুতোর দোকান খুলে বসেছেন তিনি। কিন্তু কার ভরসায় বসেন? পুলিশ যদি তুলে দেয়? মহিন্দরের নিশ্চিন্ত জবাব, ‘‘কিছু হবে না। বুড়ি মা (৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর অপরাজিতা দাশগুপ্ত) আছেন তো।’’
এলাকা ঘুরে জানা গিয়েছে, প্রতি বছর ‘বুড়ি মা’র অফিস থেকে সংগঠনের কার্ড পুনর্নবীকরণ করা হয়। শর্ত— সমস্ত মিটিং-মিছিলে যেতে হবে। সংগঠনে মাসিক কিছু চাঁদা। ব্যস, বেআইনি দোকান করার ছাড়পত্র হাতের মুঠোয়। এমনকী কোথায় দোকান দেওয়া হবে, তা-ও ঠিক করে দেন বুড়ি মা-ই। এমনটাই দাবি ওই দোকানিদের।
ফলবিক্রেতা রতন মণ্ডল বলেন, ‘‘কোনও ঝামেলা নেই। মাস গেলে পুলিশকে পঞ্চাশ টাকা দিলেই মুশকিল আসান।’’ শুধু তা-ই নয়, সংগঠনের কার্ড থাকলে তা ভাড়া দিয়ে কোনও রকম ঝুট-ঝামেলা ছাড়াই রোজ প্রায় সাড়ে চারশো টাকা করেও আয় করেন অনেকে। সোদপুর থেকে এসে প্রতিদিন জুতোর দোকান খোলেন তন্ময় প্রামাণিক। বললেন, ‘‘দোকানের মালিক অন্য কাজ করেন। এখানে বসার জন্য সংগঠনের কার্ড রয়েছে। আমিই
জুতো বিক্রি করি। দিনে আড়াইশো টাকা করে দিই।’’
সাধারণ মানুষের মুশকিলের অবশ্য কোনও সমাধান নেই। গোটা এলাকা জুড়ে যত্রতত্র বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে বিদ্যুতের তার। মাথার উপরে হেলে পড়া ত্রিপল। স্থায়ী দোকানের বর্ধিত অংশ এগিয়ে এসেছে রাস্তার উপরে। বিপদ মাথায় করেই প্রতিদিন ওই পথে চলাচল করেন হাজার হাজার মানুষ। ট্রেন ও বাসযাত্রীদের যাতায়াতের পথও অপরসির আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড। শুধু তা-ই নয়, দোকানের সামনে সর্বক্ষণ আবর্জনার স্তূপ। সকালে এক বার করে পুরসভা থেকে সাফাই হয়। তবে তা যে যথেষ্ট নয়, মানছেন বিক্রেতারাই।
স্থানীয় কাউন্সিলর তৃণমূলের অপরাজিতা দাশগুপ্ত (বুড়ি মা) বলেন, ‘‘আমি ২০০৫ সাল থেকে এখানকার কাউন্সিলর। আমি নতুন করে কাউকে বসাইনি। ২০০০ সালের আগে থেকেই ফুটপাথ জুড়ে বসে সকলে ব্যবসা করেন। বাম নেতারাই সকলকে বসিয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, আমি কাউকে তুলিওনি। আমি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে।’’ মিটিং-মিছিলে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘২১শে জুলাইয়ের সমাবেশে যেতে বলি। কিন্তু অন্য কোনও মিটিং মিছিলে যেতে কাউকে কখনও চাপ দিই না।’’
প্রতিমাসে টাকা আদায়ের ব্যাপারে কী বলছে পুলিশ? লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’