Cyclone Amphan

বিপদের দিনে অনাত্মীয়েরাই স্বজন হয়ে উঠছেন এই শহরের

এটা যদি শহরের একটা মুখ হয়, তা হলে মুদ্রার অন্য পিঠও রয়েছে। যেখানে ৩০০ বছরের পুরনো এই শহর নতুন করে শেখায় সংবেদনশীল শব্দের অর্থ।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২০ ০২:১৮
Share:

মৌপিয়া দাস।

রাস্তার ধারে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকা বৃদ্ধের দিকে ফিরেও তাকায় না এই শহর। অসুস্থকে পাশ কাটিয়ে পথচলতি মানুষজন চলে যান নিজের কাজে।

Advertisement

এটা যদি শহরের একটা মুখ হয়, তা হলে মুদ্রার অন্য পিঠও রয়েছে। যেখানে ৩০০ বছরের পুরনো এই শহর নতুন করে শেখায় সংবেদনশীল শব্দের অর্থ। সেখানে প্রতিবেশীর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাড়ার ক্লাব। অচেনা মানুষ বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। লকডাউনের ফলে যাঁদের উপার্জন বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাঁদের জন্য তৈরি হয় কমিউনিটি কিচেন। আমপানের দাপটে সংসার ভেসে গিয়েছে সুন্দরবনের যে মানুষগুলোর, তাঁদের কাছে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছে যান বিভিন্ন পেশার মানুষেরা।

উত্তরপাড়ার প্রদীপ দাসের পৈতৃক দর্জির দোকান। এখন কেনা জামাকাপড়ের যুগে দুই ভাইয়ের দোকান সে ভাবে চলে না।

Advertisement

মোবাইল রিচার্জ করিয়ে সামান্য কিছু টাকা পান প্রদীপ। এরই মধ্যে সব চেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে আসে তাঁদের সংসারে। জানা যায়, প্রদীপদের একমাত্র মেয়ে, ১২ বছরের মৌপিয়া লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত। গত ২৫ জুন তাকে ভর্তি করা হয় এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা হয়। চিকিৎসার খরচ শুনে আক্ষরিক অর্থেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল প্রদীপের।

তখনই পাশে এসে দাঁড়ায় পাড়ার ক্লাব। ক্লাবের সম্পাদক পার্থ সাহার কথায়, “মেয়েটা দারুণ প্রতিভাবান। পাড়ার আঁকা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়েছিল। আমপানের পরে ত্রাণ সংগ্রহের জন্য যে অনুষ্ঠান করেছিলাম, খুব ভাল নেচেছিল সেখানে। এমন একটা তরতাজা, ফুটফুটে মেয়ের চিকিৎসা হবে না, সেটা তো হতে দেওয়া যায় না।” ক্লাবের ফেসবুক পেজ ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে শুরু হয় আবেদন। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে এক গ্রুপ থেকে অন্য গ্রুপে। প্রদীপের প্রতিবেশী, স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মননশীল চৌধুরী নিজেদের কলেজের প্রাক্তনীদের গ্রুপেও সাহায্যের আবেদন করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন কয়েক জন। পার্থবাবু জানিয়েছেন, যে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নম্বর দিয়ে সাহায্য চাওয়া হচ্ছিল, সেখানে ইতিমধ্যেই কিছু টাকা জমা পড়েছে। প্রদীপ বলেন, “আমার হাতে ইতিমধ্যেই ৩০ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। লোকে সাহায্য না করলে অকূল পাথারে পড়তাম।’’

ফ্যাশন দুনিয়ায় কর্মরত, নিউ টাউনের বাসিন্দা আরবী চট্টোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই একাধিক বার ত্রাণ নিয়ে পৌঁছেছেন গোসাবা, পাথরপ্রতিমা, কুলতলিতে। চেষ্টা করছেন সেখানকার একটি স্কুলের সংস্কারের জন্য। ত্রাণের জন্য আবেদন করে বিপুল সাড়া পেয়েছেন বন্ধু-বান্ধবদের থেকে। আবীরের কথায়, “আমরা নিছক বিলাসিতার জন্য যে টাকা খরচ করি, সেখান থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে যদি ওঁদের পাশে দাঁড়ানো যায়, ক্ষতি কী?”

হিন্দু স্কুলের প্রাক্তনী দুই বন্ধু শান্তনু মৌলিক এবং শান্তনু ঘোষ আমপানের পরে সুন্দরবনের মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আবেদন করেছিলেন। তাঁদের ব্যাচের যাঁরা বিদেশে বা ভিন্ রাজ্যে রয়েছেন, তাঁরা এগিয়ে আসেন। হাত বাড়ান কলকাতার বন্ধুরাও। এ ছাড়াও পাড়াপড়শি, আত্মীয়েরাও জানতে পেরে সাহায্য করতে শুরু করেন। ইতিমধ্যেই দু’বার শান্তনুরা ত্রাণ নিয়ে ঘুরে এসেছেন সুন্দরবন। শান্তনু ঘোষের কথায়, “আমার ছেলের বন্ধুর পরিবারও জানতে পেরে সাহায্য করেছে।” তাঁদের উদ্যোগের কথা জানতে পেরে এক গাড়িচালক নিজের রোজগারের থেকে কিছু টাকা দিয়ে গিয়েছেন শান্তনু মৌলিকের কাছে।

অনেকেই কটাক্ষের সুরে বলছেন, লকডাউনের সময়ে ঘরবন্দি থাকার পরে আমপান ঘিরে ত্রাণ নিয়ে যেন পর্যটন শুরু হয়ে গিয়েছে। সুন্দরবন নিয়ে নিয়মিত কাজ করা, সেখানকার মানুষদের পাশে দাঁড়ানে তানিয়া দাস অবশ্য বলছেন, “এ ভাবেও তো সাহায্যটা পৌঁছচ্ছে। সেটা কি কম নাকি?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন