কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে দিশাহারা রাজ্য সরকার

কুষ্ঠ নির্মূল হওয়া দূরে থাক, ২০১৪-১৫ সালে গোটা রাজ্যের সঙ্গে খাস কলকাতায় কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যাবৃদ্ধিতে স্বাস্থ্য দফতর কার্যত দিশাহারা। এই রোগীদের একটা বড় অংশেরই শরীরে বিকৃতি শুরু হয়ে গিয়েছে। কারও চোখের পাতা বন্ধ, কারও বা হাত-পা অসাড় হয়ে বেঁকে আঙুলে পচন ধরেছে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৫ ০৪:০১
Share:

কুষ্ঠ নির্মূল হওয়া দূরে থাক, ২০১৪-১৫ সালে গোটা রাজ্যের সঙ্গে খাস কলকাতায় কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যাবৃদ্ধিতে স্বাস্থ্য দফতর কার্যত দিশাহারা।

Advertisement

এই রোগীদের একটা বড় অংশেরই শরীরে বিকৃতি শুরু হয়ে গিয়েছে। কারও চোখের পাতা বন্ধ, কারও বা হাত-পা অসাড় হয়ে বেঁকে আঙুলে পচন ধরেছে। এর অর্থ, অনেকদিন ধরে রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু সময় মতো চিকিৎসা শুরু হয়নি। কুষ্ঠরোগীদের খুঁজে বার করে চিকিৎসার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি যে রাজ্যে ধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে, এ থেকে তা প্রমাণিত হয়। রাজ্যের মধ্যে কলকাতায় শারীরিক বিকৃতিযুক্ত নতুন রোগী পাওয়া গিয়েছে সবচেয়ে বেশি।

স্বাস্থ্যকর্তারাই মানছেন, গত কয়েক বছরে রোগাক্রান্তদের চিহ্নিত করা এবং সচেতনতা-প্রচারই হয়নি, এখন যার মাসুল দিতে হচ্ছে। রোগবৃদ্ধি এমন জায়গায় পৌঁছনোয় স্বাস্থ্য দফতরের অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি (কুষ্ঠ) সুকুমার দাস জানান, সরকারি হাসপাতালের স্কিন আউটডোরে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার পরে নির্দিষ্ট সময়ে শুধু কুষ্ঠরোগীদের দেখতে বলা হচ্ছে। ঢেলে সাজা হচ্ছে সচেতনতা কার্যক্রম। পাশাপাশি, নতুন কুষ্ঠরোগী খুঁজে বার করতে পারলে জেলায় আশাকর্মী এবং কলকাতায় স্বাস্থ্যকর্মীদের দেওয়া হচ্ছে উৎসাহ ভাতা। কলকাতায় কুষ্ঠ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্মীও নিযুক্ত হচ্ছে। এর পর যদি কোথাও দৈহিক বিকৃতি রয়েছে এমন নতুন কুষ্ঠরোগী মেলে, তা হলে ওই এলাকার সরকারি কুষ্ঠকর্মীকে শো-কজ করা হবে। যদিও স্বাস্থ্যভবনের একাংশ বলছে, ‘‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।’’

Advertisement

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, প্রতি এক লক্ষ জনে নতুন কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা ১০-এর নীচে রাখতে জোর দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে ২০১৩-১৪ সালে এই সংখ্যা ৯.৬০ থাকলেও ২০১৪-১৫তে তা ১০.৭২! কলকাতার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। কলকাতায় ২০১৩-১৪ সালে ৫৪৮ জন নতুন কুষ্ঠ রোগী মেলে। ২০১৪-১৫য় মিলেছে ৯২৫ জন।

এ ছাড়া, কলকাতায় নতুন ৯২৫ জন রোগীর মধ্যে ১৫৪ জনের দেহেই বিকৃতি শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, রোগাক্রান্ত হওয়ার পর থেকে এঁরা এত দিন কোনও চিকিৎসাই পাননি। ২০১৩-১৪ সালে কলকাতায় নতুন কুষ্ঠ রোগীদের ১০.৭৭ শতাংশ (৫৯ জন) ছিল শারীরিক বিকৃতিযুক্ত (গ্রেড-টু ডিফরমিটি) সেখানে ২০১৪-১৫-য় সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ১৬.৬৫ শতাংশ! কলকাতার সঙ্গে বর্ধমান, কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, নদিয়ার মতো জেলাতেও দৈহিক বিকৃতি শুরু হয়ে গিয়েছে এমন রোগীর সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। চলতি বছর ৩০ জানুয়ারি থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারি ৩৩টি মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে ২০০ জন নতুন কুষ্ঠরোগীর সন্ধান মিলেছে।

কেন এ ভাবে বাড়ল কুষ্ঠ? বিশেষ করে কলকাতা শহরে?

সুকুমারবাবুর উত্তর, ‘‘কলকাতার সমস্যা হল এখানে কুষ্ঠ মোকাবিলায় কর্মী নিয়োগ করা যায়নি। আর কর্মী না থাকায় প্রচারও চলেনি যাতে রোগীরা সচেতন হয়ে প্রথমেই চিকিৎসকের কাছে আসেন।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘কলকাতায় কাজের সন্ধানে বাইরে থেকে প্রচুর মানুষ আসেন। তাঁরা হয়তো কিছুদিন ওষুধ খেলেন, তার পর অন্য জায়গায় চলে গেলেন। ওষুধ বন্ধ করে দিলেন। আবার যখন কয়েক বছর পর তাঁরা কলকাতায় ফিরলেন তখন শরীরে রোগ ফিরে এসেছে এবং বিকৃতি দেখা দিয়েছে।’’ তবে স্বাস্থ্য দফতরের অভিযোগ, কলকাতা পুরসভা কুষ্ঠ নিয়ে কোনও কাজই করে না বলে আরও বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। পুরসভার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক স্নেহাংশু চৌধুরী এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

রাজ্যের কুষ্ঠ বিষয়ক উপদেষ্টা প্রদীপ মণ্ডল অবশ্য বলেন, ‘‘কলকাতায় কুষ্ঠ মোকাবিলার কোনও কর্মী নেই, কোনও কাউন্সেলিং নেই, প্রচার-পরিকাঠামো নেই, যথাযথ ভাবে সব কেস নথিভুক্তও হয় না। রোগী ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিলে বা হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে তার ফলোআপ করা হয় না। এ রকম চললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’’ জাতীয় কুষ্ঠ নির্মূলীকরণ কার্যক্রমে কেন্দ্র-নিযুক্ত রাজ্যের উপদেষ্টা প্রসূন মিত্রের কথায়, ‘‘প্রতি বছর মার্চে যখন স্বাস্থ্য দফতর দেখে কুষ্ঠ খাতের টাকা খরচ হয়নি, তখন তাদের টনক নড়ে। প্রচার, সচেতনতা কার্যক্রমের কথা মনে পড়ে। এক-দু’মাস কাটলেই আবার যে কে সেই। এ ভাবে কোনও কাজের কাজ হতে পারে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন