মহম্মদ আজহারউদ্দিন (বাঁ দিকে) ও আব্দুল করিম মল্লিক। — নিজস্ব চিত্র
মত্ত যাত্রীকে গাড়িতে তুললে অপরাধ চালকেরই। এমনকী, সেই যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লেও সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন না কোনও পুলিশকর্মী। শনিবার রাতে কলকাতা পুলিশের এমনই অমানবিক মুখ দেখল শহর। অভিযোগ, অ্যাপ-ক্যাবে বেহুঁশ হয়ে পড়া এক যাত্রীকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছতে অস্বীকার করেন একটি আউটপোস্ট এবং দু’টি থানার পুলিশ। এমনকী অভিযোগ, পাল্টা ওই ক্যাবের চালককে গ্রেফতারের হুমকি দেওয়া হয়।
অ্যাপ-ক্যাবের চালকের কথায়, ‘‘যাত্রীর সাহায্যে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে থানায় ঘুরেছি। কিন্তু পুলিশ এগিয়ে আসেনি। উল্টে মত্ত যাত্রীকে কেন গাড়িতে তুলেছি, তা নিয়ে থানায় আটকে রাখারও হুমকি দেওয়া হয়েছে।’’
রবিবার কলকাতা পুলিশের ডিসি (নর্থ) শুভঙ্কর সিংহ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি বলেন, ‘‘মদ খেলে আর কী করার আছে!’’
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গত জানুয়ারি মাসে ‘গুড সামারিটান’দের জন্য নয়া আইন প্রণয়ন করেছে কেন্দ্র। রাজ্যগুলিকেও তা মানতে বলা হয়েছে। নয়া আইনে দুর্ঘটনাগ্রস্ত কোনও ব্যক্তিকে হাসপাতালে বা থানায় নিয়ে গেলে উপকারী ব্যক্তির নাম-পরিচয় জানতে চাইবে না পুলিশ। ওই ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তাঁর নাম-ধাম পুলিশকে জানাতে পারেন। এমনকী, মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্যও ওই ব্যক্তির উপরে চাপসৃষ্টি করা যাবে না। শনিবারের ঘটনায় ওই যাত্রী দুর্ঘটনার কবলে না পড়লেও অসুস্থ ছিলেন। তাঁকে থানায় নিয়ে যাওয়ার ‘অপরাধে’ পুলিশ যে ভাবে দুর্ব্যবহার করেছে, তাতে লালবাজারের কর্তাদের একাংশই প্রশ্ন তুলেছেন, এই যদি পুলিশের মুখ হয়, তা হলে ‘গুড সামারিটান’দের কী হাল হতে পারে!
কী ঘটেছে শনিবার রাতে? পুলিশ সূত্রে খবর, ক্যাবটি শেয়ারে বুক করা হয়েছিল। তাতে টালিগঞ্জে অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে মেডিক্যাল কলেজ থেকে শনিবার রাত বারোটা নাগাদ গাড়ি ভাড়া করেন পেশায় চিকিৎসক মৈনাক ঘোষ। মিন্টো পার্ক থেকে ওই গাড়িতে ওঠেন বছর পঁয়তাল্লিশের আনন্দ সিংহ। গাড়ির চালক মহম্মদ আজহারউদ্দিনের দাবি, ‘‘আনন্দবাবু যখন গাড়িতে উঠেছিলেন, তখন তাঁর জ্ঞান ছিল। টালিগঞ্জের কাছে মহাবীরতলায় আনন্দবাবুর নামার কথা ছিল। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনোর পরে তাঁর আর হুঁশ ছিল না। অনেক ডাকাডাকি করেও তিনি সাড়া না দিলে ভয় পেয়ে যাই।’’
আনন্দবাবুর অবস্থা দেখে মৈনাকবাবু এবং আজহারউদ্দিন কাছেই মহাবীরতলা পুলিশ আউটপোস্টে যান। সেখানে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা বিষয়টি শোনার পরে কেন এক জন মত্ত ব্যক্তিকে গাড়িতে তোলা হয়েছে, তা নিয়ে চালককে অপমান করেন বলে অভিযোগ। মিনিট দশেক ধরে পুলিশকে অনেক অনুরোধ করেও কোনও কাজ না হওয়ায় মৈনাকবাবুরা হরিদেবপুর থানায় যান। অভিযোগ, সেখানেও পুলিশ তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। মত্ত ব্যক্তিকে গাড়িতে কেন তোলা হয়েছে, এই অভিযোগে চালককেই হেনস্থা করা হয়। ওই চালকের কথায়, ‘‘যাত্রীর নিরাপত্তার কথা ভেবে থানায় গিয়েছিলাম, কিন্তু পুলিশ এমন আচরণ করল, যেন আমরাই অন্যায় করেছি।’’ গাড়ির অন্য যাত্রী মৈনাকবাবুর কথায়, ‘‘অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে যাচ্ছিলাম। সহযাত্রীর অবস্থা দেখে সাধ্যমতো চালকের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু আউটেপোস্ট ও থানার পুলিশ যে আচরণ করলেন, তা ভাবা যায় না।’’
শেষমেশ, রাত একটা নাগাদ ওই চিকিৎসককে টালিগঞ্জে নামিয়ে চালক গাড়ির মালিককে ঘটনাটি জানান। মালিক ও চালকের বাড়ি আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা এলাকায়। মালিকের পরামর্শমতো চালক ওই অচৈতন্য যাত্রীকে নিয়ে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানায় পৌঁছন। কিন্তু সেখানেও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাঁদের। রাজাবাজারের বাসিন্দা গাড়ির মালিক আব্দুল করিম মল্লিকের কথায়, ‘‘রাত দেড়টা নাগাদ আমহার্স্ট স্ট্রিট থানায় কর্তব্যরত পুলিশ আধিকারিককে ঘটনাটি বললে তিনি আমাদের তিন জনকেই গ্রেফতারির হুঁশিয়ারি দেন। সাফ বলে দেন, ‘‘মাতাল লোককে গাড়িতে তুলেছেন। তার দায়িত্ব পুলিশ নেবে কেন?’’
অগত্যা এর পরে গাড়ির মালিক ১০০ নম্বরে ডায়াল করেন। ওখানকার অফিসার তাঁদের থানাতেই বসে থাকার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণ পরে যে অফিসার তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তিনিই আবার লালবাজারের নির্দেশে অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তির কথা বলতে শুরু করেন। এর পরেই আনন্দ সিংহকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
যদিও এর মধ্যে কোনও অপরাধ দেখছেন না আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ওই আধিকারিক। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও মত্ত ব্যক্তিকে ট্যাক্সিতে ওঠানোর নিয়ম নয়। এ ক্ষেত্রে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তাতে পুলিশের কী-ই করার আছে?’’
তবে গাড়ির মালিকের মন্তব্য অস্বীকার করে ওই আধিকারিক বলেন, ‘‘১০০ ডায়ালে ফোন করার পরে পুলিশই অচৈতন্য ব্যক্তিকে মেডিক্যালে গিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করেছে।’’ পুলিশ জানিয়েছে, রাত দু’টো নাগাদ মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয় আনন্দ সিংহকে। প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে জ্ঞান ফিরলে তাঁর পরিজনেদের খবর দেওয়া হয়। তাঁরা এসে হাসপাতাল থেকে আনন্দবাবুকে নিয়ে যান।
অসুস্থ ব্যক্তিকে হাসপাতালে পৌঁছনোর জন্য যে ভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, তাতে ক্ষুব্ধ গাড়ির চালক। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওই ব্যক্তি যখন ফোনে গাড়ি বুকিং করেন, তখন তো জানতাম না তিনি মত্ত অবস্থায় আছেন। গাড়িতে তোলার পরে যাত্রীকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া আমার কর্তব্য।’’ চালকের কথায়, ‘‘যাত্রী মত্ত বলে তাঁকে তো রাস্তায় ফেলে চলে যেতে পারি না!’’
কী বক্তব্য পুলিশকর্তাদের? ঘটনা প্রসঙ্গে ডিসি (সাউথ-ওয়েস্ট ডিভিশন) মিরাজ খালিদ বলেন, ‘‘ঘটনার কথা জানি না। তবে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে পুলিশের অবশ্যই এগিয়ে আসা উচিত।’’ যদিও ডিসি (নর্থ) শুভঙ্কর সিংহ সরকার তাঁর বাহিনীর কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘‘মদ খেলে আর কী করার আছে!’’ এর পরে অবশ্য কোনও প্রশ্নের জবাব না দিয়েই ফোন কেটে দেন তিনি।