প্রতীকী ছবি।
বাসে পাশের আসনে বসে কোনও সাত-আট বছরের ফুটফুটে মেয়ে মাঝেমাঝেই কেশে চলেছে। বাইরে থেকে দেখে কল্পনাও করা যাবে না যে, ছোট্ট মেয়ে এমন যক্ষ্মায় আক্রান্ত যা প্রচলিত ওষুধে সারবে না। অর্থাৎ, যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় ‘মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ (এমডিআর) টিবি বলা হয়।
মাসখানেক আগে দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রক থেকে প্রকাশিত সমীক্ষা রিপোর্টে দেশের অন্য কয়েকটি শহরের পাশাপাশি কলকাতায় শিশুদের ভিতর এমডিআর যক্ষ্মার বাড়বাড়ন্তের কথা জানতে পেরে রীতিমতো উদ্বিগ্ন পুর-স্বাস্থ্যকর্তারা। তাঁরা স্বীকার করছেন, বড়দের পাশাপাশি শিশুদের মধ্যেও যে এ রোগ দ্রুত ছড়াচ্ছে সে বিষয়ে তাঁরা গুরুত্ব দেননি। কেন্দ্রের সমীক্ষা রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে গত ১৭-৩১ জুলাই কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় ‘অ্যাকটিভ কেস সার্চ’ বা নতুন যক্ষ্মা রোগী খোঁজার কর্মসূচিতে আলাদা করে শিশু যক্ষ্মা রোগীদের চিহ্নিত করার উপরে জোর দেওয়া হয়েছে।
ঠিক তিন বছর আগে ২০১৪ সালের এপ্রিলে একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাহায্য নিয়ে কলকাতা, দিল্লি, চেন্নাই ও হায়দরাবাদে শিশুদের ভিতর যক্ষ্মার হার নিয়ে সমীক্ষা শুরু করে স্বাস্থ্যমন্ত্রকের যক্ষ্মা মোকাবিলা বিভাগ। ক্রমশ সমীক্ষায় যুক্ত হয় নাগপুর, সুরাত, বেঙ্গালুরু, গুয়াহাটি ও বিশাখাপত্তনম। ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সমীক্ষা চলে মোট ৭৬ হাজার শিশুর ভিতর। তার মধ্যে ৫৫০০ জনের দেহে যক্ষ্মার জীবাণু মিলেছে। এই আক্রান্তদের মধ্যে কলকাতার শিশু রয়েছে প্রায় ৮০০ জন। স্বাস্থ্যমন্ত্রক সূত্রের খবর, এই যক্ষ্মা আক্রান্ত শিশুদের ৯%-এর দেহে ‘এমডিআর’ যক্ষ্মা মিলেছে! এতদিন পর্যন্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রকের রিপোর্ট ছিল— দেশে যক্ষ্মা আক্রান্ত শিশুদের ৬% এমডিআর যক্ষ্মায় আক্রান্ত। কলকাতা-সহ ৯ শহরে করা নতুন সমীক্ষায় সেটা ৩ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্যমন্ত্রকও।
স্বাস্থ্যমন্ত্রকের যক্ষ্মা মোকাবিলা বিভাগের দায়িত্বে থাকা সুনীল খাপাডের কথায়, ‘‘পরিসংখ্যানটা আমাদের ভাবাচ্ছে, তবে হঠাৎ করে শিশুদের ভিতরে এমডিআর যক্ষ্মা বেড়ে গিয়েছে এখনই এমন ভেবে নেওয়াটাও ঠিক হবে না।
হতে পারে হয়ত শুধুমাত্র শিশুদের মধ্যে এত দিন এ ভাবে আক্রান্তের খোঁজ করা হয়নি বলে এত কেস সামনে আসেনি।’’ সেই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘‘শুধুমাত্র শিশুদের পরীক্ষা করার জন্য প্রতিটি রাজ্যে আমরা একাধিক ‘সিবিন্যাট মেশিন’ পাঠাচ্ছি। যাতে দ্রুত এবং নিখুঁত ভাবে তাদের কফ পরীক্ষা করা সম্ভব হয়।’’কলকাতা পুরসভার টিবি অফিসার বিজয় কর জানিয়েছেন, তাঁদের ট্যাংরা পরীক্ষাগারে ইতিমধ্যে এইরকম দু’টি যন্ত্র এসেছে। কিন্তু শিশুদের যক্ষ্মা পরীক্ষার ক্ষেত্রে এমন কিছু সমস্যা রয়েছে যার সমাধান শুধু সিবিন্যাট যন্ত্রে হবে না।
যেমন, শিশুদের অনেকেই কফ বার করতে পারে না। গিলে ফেলে। সে ক্ষেত্রে তাদের এক দিন হাসপাতালে ভর্তি করে পেট থেকে গ্যাসট্রিক অ্যাসপিরেট বা কফের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষায় পাঠাতে হয়। সরকারি হাসপাতালে শয্যা জোগাড় করাটাও সমস্যার। সমস্যা রয়েছে প্রয়োজনীয় কর্মীর সংখ্যায়ও। জুলাই মাসে পুরসভা যে ‘অ্যাকটিভ কেস সার্চ’ কর্মসূচি নিয়েছিল তাতে ১৪ দিনে কলকাতার ১৪৪টি
ওরার্ডের বস্তি এলাকার ৩ লক্ষ ৭৪ হাজার ২৫০ জন মানুষের সঙ্গে বাড়ি গিয়ে কথা বলা হয়েছিল। এবং সেটা করেছিলেন মাত্র ৫০০ জন স্বাস্থ্যকর্মী। এ ব্যাপারে পুরসভাকে সাহায্য করেছিল ‘টিউবারকিউলোসিস হেলথ অ্যাকশন লার্নিং ইনিশিয়েটিভ’ নামে একটি সংস্থা। কলকাতা পুরসভার কর্তারাই জানাচ্ছেন, কর্মী আরও বেশি পাওয়া গেলে স্কুলে-স্কুলে গিয়েও শিশুদের ভিতর যক্ষ্মা পরীক্ষার কথা ভাবা যেতে পারে।
কলকাতা পুরসভার সাম্প্রতিক নতুন যক্ষ্মা রোগী খোঁজার কর্মসূচিতে ৩০১৪ জনকে কফ পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয়েছিল। তার মধ্যে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় রাজি হয়েছিলেন ২৮৯২ জন। এঁদের মধ্যে ১২৬ জনের দেহে যক্ষ্মার জীবাণু মিলেছে। আরও ৬০ জনের এক্স-রে করে বুকে ভাল রকম সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। পুরসভার কর্তারা জানিয়েছেন, এঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জন শিশুও রয়েছে।