দুষ্কৃতীদের দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে ঝগড়া, মাঝরাতে গুলিবৃষ্টি। তার জেরেই হরিদেবপুরে মৃত্যু হয়েছিল এক যুবকের। কিন্তু সেই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত শুধু একটি গোষ্ঠীর লোকদেরই কেন গ্রেফতার করা হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে কলকাতা পুলিশের নিচুতলায়।
৮ জুলাই হরিদেবপুর কবরডাঙায় এক পানশালায় গোলমাল বাধে দুই দুষ্কৃতী দলের। এক দলের নেতৃত্বে ছিল নান্টে, ভোঁতকার মতো দুষ্কৃতী, অন্য দলে ছিল কালী, দুর্গার মতো দুষ্কৃতীরা। পুলিশের দাবি, এলাকা দখল নিয়ে নান্টেদের সঙ্গে কালীদের গোলমাল ছিলই। পানশালাটি বকলমে কালীরাই চালায়। পানশালায় এক নর্তকীর সঙ্গে নান্টেদের গোলমাল বাধায় কালী-দুর্গারা নান্টেদের মারে বলে অভিযোগ। পুলিশ জানায়, বদলা নিতেই দুর্গার দলবলের হাতে মার খেয়ে ফিরে এসে গুলি চালায় নান্টে-সহ তার দলের পাঁচ জন। মারা যান রাহুল মজুমদার নামে কালীদের ঘনিষ্ঠ এক যুবক। পুলিশ জানাচ্ছে, নান্টের গুলিতেই মৃত্যু হয় রাহুলের।
এই ঘটনায় বাবলু ঘোষ ওরফে নান্টে এবং তার চার শাগরেদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ছ’টি আগ্নেয়াস্ত্র। কিন্তু তদন্তকারীদের একাংশ জানাচ্ছেন, ওই গোলমালে কালী-দুর্গা এবং তাদের শাগরেদদের জড়িত থাকারও একাধিক প্রমাণ মিলেছে। সে দিন হাঙ্গামায় প্ররোচনা দিয়েছিল তারাই। তা হলে কালী-দুর্গাদের গ্রেফতার করা হবে না কেন, সে প্রশ্ন তুলেছেন পুলিশের একাংশ।
এখানেই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে পুরভোটের আগে উত্তর কলকাতার কাশীপুরে দু’দল দুষ্কৃতীর বিরুদ্ধে হামলার প্রসঙ্গ। প্রকাশ্যে গুলি-বোমাবাজি হওয়ার পরেও ওই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। লালবাজারের অন্দরেরই খবর, দু’টি গোষ্ঠীর পিছনেই শাসক দলের প্রশ্রয় ছিল। এ বার হরিদেবপুরের ক্ষেত্রেও সেই প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। পুলিশ সূত্রের খবর, কালী-দুর্গার পিছনে শাসক দলের কয়েক জন প্রভাবশালী নেতার হাত রয়েছে। সে কারণেই বৈধ অনুমতিপত্র ছাড়া ওই পানশালা চলছিল। আইনে নিষিদ্ধ হলেও নিয়মিত বসত নাচের আসর। পানশালাটির সামনেই হরিদেবপুর থানার একটি কিয়স্ক রয়েছে। তা সত্ত্বেও কী ভাবে ওই পানশালায় ‘বেআইনি’ কাজকর্ম চলত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের অন্দরেই।
লালবাজার সূত্রের খবর, মাস সাতেক আগে হরিদেবপুর থানায় কর্মরত এক সাব-ইনস্পেক্টর কালী-দুর্গার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তৎপর হয়েছিলেন। তার পরে ২৪ ঘণ্টা কাটতে না-কাটতেই বদলি করে দেওয়া হয় তাঁকে। বিভাগীয় ডিসি-র কাছে সেই বদলির নির্দেশ এসেছিল লালবাজারের উপরমহল থেকে। কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘তার দিন সাতেক আগে ওই অফিসারই কাজের জন্য ওই শীর্ষকর্তার বাহবা কুড়িয়েছিলেন। আর কালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে রোষে পড়লেন তিনি।’’ এখানেই শেষ নয়। কালী-দুর্গার প্রতাপের কথা শুনিয়েছেন লালবাজারের আর এক অফিসারও। তিনি জানাচ্ছেন, গত বছর পুজোর আগে ওই পানশালায় হানা দিয়েছিল গুন্ডাদমন শাখার একটি দল। বেনিয়ম ধরা পড়লেও ব্যবস্থা না নিয়েই ফিরে আসতে হয়েছিল ওই দলকে। সৌজন্য, সেই উপরতলার ফোন।
লালবাজারের একাংশের খবর, এ বারেও গোলমাল ও হাঙ্গামার অভিযোগে কালী-দুর্গাকে গ্রেফতার করাই যেত। তাতে হরিদেবপুরের পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে থাকত। আরও বেশি অস্ত্র উদ্ধারের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু হরিদেবপুর কাণ্ডের পরে মাস ঘুরতে চললেও কালী-দুর্গাকে গ্রেফতারের উপরে কার্যত বিধিনিষেধ রয়েছে। হরিদেবপুর কাণ্ডের পর লালবাজারের শীর্ষকর্তারা বলেছিলেন, ‘‘গোলমালের সঙ্গে যে-ই জড়িত থাকবে, তাকেই গ্রেফতার করা হবে।’’ তা হলে এখনও নান্টেদের বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর কাউকে গ্রেফতার করা
হল না কেন?
লালবাজারের দাবি, দুর্গা-কালীদের ভূমিকা খতিয়ে দেখার জন্য আলাদা করে তদন্ত চলছে। কিন্তু ঘটনার পর কেটে গিয়েছে প্রায় তিন সপ্তাহ, তবুও কেন ওই তদন্ত শেষ হল না? কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। তাই এখনই এ বিষয়ে কিছু
বলা সম্ভব নয়।
অন্য দিকে, মঙ্গলবার গভীর রাতে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের মধ্যেই নান্টের উপরে হামলার চেষ্টা হয় বলে খবর। জেলের এক অফিসার জানান, পুরনো শত্রুতার জেরে এক বন্দি নান্টের উপরে অতর্কিতে হামলা চালায়। যদিও বাকি বন্দি ও কারারক্ষীদের তৎপরতায় তেমন বড় ঘটনা ঘটেনি।