নিয়ম মানলে সেতু বন্ধের প্রয়োজনই পড়ত না

পুজোর আগে তিন দিন বন্ধ রেখে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথা ছিল বিজন সেতুর। কিন্তু ভিড়ের কথা মাথায় রেখে কলকাতা পুলিশ কেএমডিএ-কে এই সময়ে তা না করার অনুরোধ করে। এই দেরি ঝুঁকির হয়ে যাচ্ছে না তো? কী অবস্থা বিজন সেতুর? আনন্দবাজারের তরফে ঘুরে দেখলেন সেতু বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ সোম। সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে কী কী নিয়ম মেনে চলতে হবে, তা স্পষ্ট বলা রয়েছে ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেস (আইআরসি)-এর নির্দেশিকায়।

Advertisement
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৩:০৭
Share:

পর্যবেক্ষণ: পুজোর জন্য পিছিয়ে গিয়েছে বিজন সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা। বৃহস্পতিবার। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

যত দূর শুনেছি, পুজোর পরে কাজ শুরু হবে। অর্থাৎ আরও বেশ খানিকটা দেরি। কিন্তু, সিদ্ধান্তটা কি যথাযথ হল? যত দ্রুত সম্ভব ওই সেতুর ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্পেকশন’ করাটা জরুরি ছিল।

Advertisement

সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে কী কী নিয়ম মেনে চলতে হবে, তা স্পষ্ট বলা রয়েছে ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেস (আইআরসি)-এর নির্দেশিকায়। দেশ-বিদেশের যে ৬৫টি সেতু তৈরির সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম, তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু ওই নির্দেশিকা মেনে চলেছি। ২০১২ সালে সিকিমের ৫৫টি সেতুর ক্ষেত্রে ভূকম্প-পরবর্তী যে পরীক্ষা (পোস্ট-আর্থকোয়েক অ্যাসেসমেন্ট) করেছিলাম, সেখানেও ওই নিয়ম মেনেই কাজ করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, সেগুলি এ রাজ্যে শুধু বিজন সেতুর ক্ষেত্রেই নয়, কোথাও কি মানা হয়? সেগুলি নিয়মিত মানা হলে তো সেতু বন্ধ করে স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রয়োজনই পড়ে না। কারণ, আবারও আইআরসি-র কথাই বলছি, কোনও সেতু নিরাপদ কি নিরাপদ নয়, তা অঙ্ক করে বা ‘অ্যানালিটিক্যাল প্রসিডিয়োর’-এর মাধ্যমেই বোঝা সম্ভব। যদি একমাত্র ‘অ্যানালিটিক্যাল প্রসিডিয়োর’-এ ধরা না পড়ে, তা হলেই ভারবহন ক্ষমতার পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ আইআরসি-ই বলছে, সেতুর ভার বহন ক্ষমতা পরীক্ষা একদম চূড়ান্ত ধাপ। আমার প্রশ্ন একটাই, প্রাথমিক ধাপগুলি সম্পূর্ণ করে কি চূড়ান্ত ধাপে যাওয়া হচ্ছে? না কি একবারেই চূড়ান্ত ধাপে চলে যাওয়া হচ্ছে? বিজন সেতু সম্পর্কে তথ্য কোথায়? সবটাই অজানা।

প্রতিদিন সেতু দেখভালের যে কাজ, সেটাই বিজন সেতুর ক্ষেত্রে হয়নি। অবশ্য কোনও সেতু বা উড়ালপুলের ক্ষেত্রেই কি সেটা হয়? যদি হত, তা হলে প্রতিটা এক্সপ্যানশন জয়েন্টে এ রকম গাছ, এক্সপ্যানশন জয়েন্টগুলি নোংরা-ধুলোয় বন্ধ হয়ে যাওয়া কী ভাবে সম্ভব? সেতু-বিজ্ঞান বলছে, এক্সপ্যানশন জয়েন্টের মুখ থাকবে সব সময়ে ফাঁকা, যাতে আলোকরশ্মি এক দিক থেকে অন্য দিকে যেতে পারে। কিন্তু বিজন সেতুর ক্ষেত্রে তো এক্সপ্যানশন জয়েন্টগুলোর মুখই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ফলে অবধারিত ভাবে যা হওয়ার তাই হয়েছে। ‘ইমপাউন্ডিং’, অর্থাৎ সেতুর সিমেন্টের স্ল্যাবগুলি একটির উপরে আর একটি উঠে যেতে শুরু করেছে। তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘর্ষণ শুরু হয়েছে। যা সেতুর স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে খুবই উদ্বেগের।

Advertisement

এগুলো খুবই ছোট-ছোট সমস্যা। প্রতিদিনের রুটিন রক্ষণাবেক্ষণ করলে কিন্তু এমন হওয়ার কথা নয়। বরং রোজকার রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যেই এক্সপ্যানশন জয়েন্টগুলির মুখ বন্ধ হচ্ছে কি না, সেগুলির ফাঁকে গাছ জন্মাচ্ছে কি না, তা নজরে পড়ার কথা। বেয়ারিং পরিষ্কার এবং সেতুর নিকাশি স্পাউটগুলিও পরিষ্কার করার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে সেগুলো করা হয়নি, তা পুরোপুরি স্পষ্ট।

নতুন রং করা সেতুর গায়ে তরতরিয়ে বেড়ে উঠছে গাছ। (ডান দিকে) স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন বিশ্বজিৎবাবু। বৃহস্পতিবার। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

সেতুর নীচে দোকানগুলির দেওয়াল একদম সেতুর মাথা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। ফলে সেতুর নীচের স্ল্যাবের কী অবস্থা, তা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। অনেক জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে যে, সেতুর নীচে সিমেন্টে জল ঢুকে তাতে নোনা ধরে গিয়েছে। এর ফলে চাঙড় খসে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, অনেক জায়গায় লোহার রডে মরচেও পড়ে গিয়েছে। লোহার রড বেরিয়ে এসেছে কোথাও কোথাও। রেললাইনের উপরে যে অংশটুকু রয়েছে, তার সমীক্ষাও দ্রুত করা জরুরি।

বিদেশে কোনও সেতু পরীক্ষার পরে সেই তথ্য জনসমক্ষে আনা হয়। কিন্তু এখানে কেউই কিছু জানতে পারেন না। না হলে বিবেকানন্দ উড়ালপুল বা মাঝেরহাট সেতু কেন ভেঙে পড়ল, বিশেষজ্ঞদের রিপোর্ট, কেন জানা গেল না? এই সমস্ত ব্যর্থতাগুলো কাটাছেঁড়া করেই তো সাফল্যের দিকে যাওয়া সম্ভব। তা না হলে এক্সপ্যানশন জয়েন্টের ফাঁক যেমন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আলোকরশ্মি দেখা যায় না, সেতুর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আসল সত্যিটাও সাধারণ মানুষ কোনও দিনই জানতে পারবেন না!

(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ভিজ়িটিং প্রফেসর এবং সেতু ডিজ়াইনার)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন