যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু বললেন উপাচার্য না থাকার কথা। যা আদতে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের নির্দেশেই হয়েছে বলে অভিযোগ। গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
অ্যান্টি র্যাগিং কমিটির ব্যর্থতাই কি যাদবপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রমৃত্যুর কারণ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য না থাকার প্রসঙ্গ টেনে আনলেন রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জু বসু। সোমবার তিনি বললেন, সব সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা তো আমাদের হাতে থাকে না। উপাচার্য না থাকলে সমস্যা হয়। উনি থাকলে কিছু সুবিধা তো হতই!
গত ৩১ মে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন সুরঞ্জন দাস। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলেন তিনি। পরে ওই পদে অস্থায়ী উপাচার্য হিসাবে যাদবপুরেরই ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক অমিতাভ দত্তকে নিয়োগ করেছিলেন রাজ্যপাল বোস। কিন্তু গত ৪ অগস্ট অমিতাভও ইস্তফা দেন। পরে জানা যায়, রাজ্যপাল বোসই তাঁকে বলেছেন ইস্তফা দিতে। এর পর আর নতুন করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে স্থায়ী বা অস্থায়ী ভাবে কাউকে নিয়োগ করেননি রাজ্যপাল। ফলত উপাচার্যহীন হয়েই থাকে যাদবপুর। আর এই পরিস্থিতিতেই গত সপ্তাহে ঘটে দুর্ঘটনা। যার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উপাচার্য প্রসঙ্গ টেনেছেন স্বয়ং বিশ্ববিদ্য়ালয় কর্তৃপক্ষ। দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বলেছেন, ‘‘উপাচার্য থাকলে এ ভাবে সবটা আমাদের উপর চলে আসত না।’’ গুরুত্বের বিচারে উপাচার্যের এক ধাপ পরেই থাকেন রেজিস্ট্রার। তাঁর মন্তব্যে তাই প্রশ্ন উঠেছে, তিনি কি পরোক্ষে উপাচার্য নিয়োগের ভারপ্রাপ্ত রাজ্যের আচার্য তথা রাজ্যপালের দিকেই দায় ঠেলছেন? যেমনটা দিন কয়েক আগে বলেছিলেন স্বয়ং রাজ্য়ের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু?
গত শুক্রবার যাদবপুরের অস্থায়ী উপাচার্যের ইস্তফার পর শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য জানিয়েছিলেন, রাজ্যপালের নির্দেশেই যাদবপুরের অস্থায়ী উপচার্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন অমিতাভ। যিনি নিয়োগ করছেন, তিনিই ইস্তফা দিতে বলছেন। এমনই মন্তব্য করেছিলেন ব্রাত্য। তার ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় গত ৯ অগস্ট, বুধবার ওই দুর্ঘটনা ঘটে। যাদবপুরের মেন হস্টেলের তিন তলার বারান্দা থেকে পড়ে মারা যান বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের এক ছাত্র। অভিযোগ ওঠে র্যাগিংয়ের। অভিযোগ ওঠে যাদবপুরের হস্টেল আঁকড়ে পড়ে থাকা প্রাক্তনীদের ‘অত্যাচার’-এরও । স্বাভাবিক ভাবেই এর পর আঙুল ওঠে কর্তৃপক্ষের দিকে। প্রশ্ন ওঠে, তাঁদের নজর এড়িয়ে এবং নিয়মের পরোয়া না করে কী ভাবে দিনের পর দিন আইন ভেঙে হস্টেলে পড়ে থাকতেন এই প্রাক্তনীরা?
সোমবার এ নিয়ে বার বার প্রশ্নের মুখে পড়েন রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জুও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিরাপত্তার জন্য অ্যান্টি র্যাগিং কমিটির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল তাঁকে। জানতে চাওয়া হয়েছিল, কমিটির সদস্যরা বহু পুরনো। কেন সেই প্যানেলে কোনও বদল হয়নি? জবাবে সটান উপাচার্যের না থাকার যুক্তিই দেন স্নেহমঞ্জু। তিনি বলেন, ‘‘ঠিকই বলেছেন। উপাচার্য থাকলে এবং এগ্জিকিউটিভ কমিটির বৈঠক নিয়মিত করতে পারলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা হত। উপাচার্য না থাকলে অনেক ক্ষেত্রে অনেক অনুমোদন পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে। ’’
উল্লেখ্য, যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য ইতিমধ্যেই রাজ্যপালকে দায়ী করেছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য। যাদবপুরের ঘটনায় বিজেপির তরফে যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের উপর অভিযোগ আনা হচ্ছে, তখন তিনি বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসাশনিক দায়িত্ব শীর্ষে এখনও রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তথা রাজ্যপাল। ফলে দায় যদি কারও উপর বর্তায়, তবে তাঁর উপরেই।
সম্প্রতি রাজ্যের অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করা নিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে টানাপড়েন চলছে রাজ্য সরকারের। সরকারের বক্তব্য, রাজ্যপাল তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। নিয়মের বাইরে গিয়ে শিক্ষা দফতরের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ করছেন অস্থায়ী উপাচার্য। যার মধ্যে একটি যাদবপুর। যাদবপুরের ঘটনায় প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা বলে, শিক্ষামন্ত্রী রাজ্যপালের সেই সব পদক্ষেপের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন হয়তো। সোমবার দেখা গেল, যাদবপুরের রেজিস্ট্রার স্নেহমঞ্জুও সরকারের সুরেই উপাচার্যের না থাকা নিয়ে মন্তব্য করলেন। রাজনীতির কারবারিদের অনেকেই বলেছেন, তবে কি এখন সরকারের দেখানো পথেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপালের সিদ্ধান্তহীনতাকেই দায়ী করলেন?