পাইকপাড়া

অন্য ভাষায় অন্য রকম কথা, কেমন অচেনা

গায়ে গায়ে বাড়ি নেই, বরং গাছগাছালিতে ভরা। বিশাল জিমখানা গ্রাউন্ড। টলটলায়মান ঝিল, গুরুগম্ভীর মাথা উঁচু করা পুরুষালি ট্যাঙ্ক— কলকাতার অনেকটা অংশে জল সরবরাহ করে চলেছে সদর্পে! জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি এই পাড়াতেই। কেবল জন্মটাই যা বাগবাজারে। পাড়াটির নাম টালা পার্ক। তারাশঙ্কর সরণি, খেলাৎবাবু লেন, ইন্দ্র বিশ্বাস রোড, অনাথনাথ দেব লেন, সিমলাই পাড়া লেন, রানি রোড— এ সব নিয়েই এ অঞ্চল।

Advertisement

জগন্নাথ বসু

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০০:১৯
Share:

গায়ে গায়ে বাড়ি নেই, বরং গাছগাছালিতে ভরা। বিশাল জিমখানা গ্রাউন্ড। টলটলায়মান ঝিল, গুরুগম্ভীর মাথা উঁচু করা পুরুষালি ট্যাঙ্ক— কলকাতার অনেকটা অংশে জল সরবরাহ করে চলেছে সদর্পে! জ্ঞান হওয়া ইস্তক আমি এই পাড়াতেই। কেবল জন্মটাই যা বাগবাজারে। পাড়াটির নাম টালা পার্ক। তারাশঙ্কর সরণি, খেলাৎবাবু লেন, ইন্দ্র বিশ্বাস রোড, অনাথনাথ দেব লেন, সিমলাই পাড়া লেন, রানি রোড— এ সব নিয়েই এ অঞ্চল।

Advertisement

ছেলেবেলার আবছা স্মৃতিতে এখনও দেখতে পাই— বাড়ির সামনের মাঠে ভোর থেকেই চলছে পুলিশের কুচকাওয়াজ। সাদা পোশাকের সার্জেন্টরা এক সারিতে, খাকি পোশাক অন্য দিকে, আর লাল পাগড়ি পরিহিত কনস্টেবলরা অন্য সারিতে। আর চিৎকার করছেন দলনেতা, ‘লেফট-রাইট, লেফট-রাইট’। সুশৃঙ্খল প্যারেডের সঙ্গে তালে তালে বাজছে পুলিশ ব্যান্ড। বিউগলের আওয়াজে পরিবেশটাই অন্য রকম হয়ে যেত। আমি আর আমার ছোট ভাই গৌতম ছুটে যেতাম বারান্দায় চোখ কচলাতে কচলাতে, উপভোগ করতাম ওই দৃশ্য। মনে পড়ে আজও বিউগলের সুরে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত।

একটা সময় স্নো বলতে হিমানি বুঝত লোকে। এত বিখ্যাত ছিল হিমানি কোম্পানি। ওঁদের প্রাসাদোপম বাড়ি ছিল টালা পার্কে। বেঙ্গল বক্সে শক্ত বোর্ডের ইংরেজি ক্যালেন্ডার তখন প্রায়ই বাংলা সিনেমায় দেখা যেত। দোতলা বাসের গায়ে ইলোরা কুঁচ অয়েলের বিজ্ঞাপনের কথা অনেকেরই মনে থাকবে। এঁরাও থাকতেন সব এ পাড়াতেই। সম্পন্ন হয়েও সে রকম ঠাটবাট দেখিনি ওঁদের। পাড়ার সাধারণদের মধ্যে মিলেমিশে থাকতেন সবাই। দোল-দুর্গোৎসবে প্রতিবেশীদের মধ্যে কোলাকুলি পেন্নাম ঠোকা এ সব ছিল তখন দস্তুর। আবার এ পাড়ার যুগের যাত্রী সঙ্ঘ ফুটবল ক্লাবটির কথা না বললে অঞ্চলটিকে ধরাই যাবে না। ক্লাবটির স্থপতি ছিলেন নিশীথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ধুতি-বাংলা শার্টে একজন নিপাট বাঙালি। নিরহঙ্কার, নম্র কিন্তু অসম্ভব জেদি। কত ফুটবলার যে তাঁর হাতে তৈরি হয়েছে কী বলব! যুগের যাত্রীর অনুশীলন দেখতে ভিড় জমে যেত মাঠে। এখান থেকেই শুরু করে সুধীর কর্মকার, তরুণ বসুরা পরে ময়দান কাঁপিয়েছেন।

Advertisement

আমার ভালবাসার অনেকটা অংশ জুড়ে আকাশবাণী কলকাতা। জীবনের বহু ভাল ভাল বছর কেটে গিয়েছে ওখানে। সেই রেডিও স্টেশনের শুরুর ট্রান্সমিটারটি বসানো হয়েছিল আমার পাড়াতেই। দু’টি বড় বড় টাওয়ার, নীচে কাজ চালানো সম্প্রচার ব্যবস্থা। যুববাণী প্রচারতরঙ্গ বহু দিন এখান থেকেই সম্প্রচারিত হয়েছে।

আমার সবচাইতে অহঙ্কার ছিল প্রতিবেশীদের নিয়ে। যেমন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়— বীরভূম থেকে কলকাতায় এসে এ-পাড়া ও-পাড়ায় বাস করে শেষমেশ পাকাপাকি বাসস্থান গড়লেন টালা পার্কে। কত দিন দেখেছি বাড়ির সামনে আরামকেদারায় মগ্ন হয়ে রয়েছেন। পাশে চুরুট হাতে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। তিনিও এ পাড়ারই। তারাশঙ্করের বাড়ির কিছুটা দূরে থাকতেন নটনাট্যকার মহেন্দ্র গুপ্ত, চলচ্চিত্রকার তপন সিংহ, সাময়িক ভাবে ছিলেন শ্রীপান্থ এবং শঙ্খ ঘোষ। আরও একটু তফাতে গেলে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখনীয় পত্রিকা ‘শনিবারের চিঠি’-র দফতর। আর সেই বাড়িরই বাসিন্দা স্বয়ং সজনীকান্ত দাস। যাঁর তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার কলমকে সমীহ করে চলতেন নামী কবি-সাহিত্যিকরা। চিত্রপরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় অন্য ধারার ছবিতে সুবিধে করতে না পেরে নাম লেখালেন মেনস্ট্রিম ছবিতে। তাঁর ওই বাঁক নেওয়ার সময়টায় টালা পার্কে ছবির কনটেন্ট কাস্টিং নিয়ে বহু বার আলোচনা করতে দেখেছি অভিনেতা প্রেমাংশু বসুর সঙ্গে। নরেন্দ্রনাথ মিত্র লিখতে লিখতে মুড অফ হয়ে গেলে টালা পার্কে হাঁটতে আসতেন। আমাকে এক বার বলেছিলেন, এখানকার এই সুন্দর আবহাওয়ায় প্লটগুলি যেন তরতরিয়ে চলে আসে। নরেন্দ্রনাথের গল্পে এই অঞ্চলের মানুষজন, দোকানপাট, প্রকৃতি বারবার ঢুকে পড়েছে। এ ছাড়া বিমল কর, গৌরকিশোর ঘোষ, চণ্ডী লাহিড়ী আর অসামান্য প্রতিভাধর শিল্পী অন্নদা মুন্সী বাস করে গিয়েছেন এ পাড়ায়। পার্কের পিছন দিকটায় থাকতেন বিখ্যাত সেতারী মুস্তাক আলি খান। রানি রোডের ও দিকটায় মোহন কাননে জলসা বসত রাতভর। গুণী শিল্পীরা সব তাতে অংশ নিতেন।

এ বার একটু অন্য কথায় আসি। কিছু দিন আগে পর্যন্ত বৃষ্টি হলেই এ পাড়ায় জল জমে যেত। লো-ল্যান্ড, তাই কিছু করা যেত না। প্রাক্তন কাউন্সিলর দুলাল মুখোপাধ্যায় কিংবা টুকুবাবু পাড়ায় পাড়ায় সাইকেল নিয়ে ঘুরতেন। আমাদের বাড়ির সামনে এসে হাঁক পাড়তেন— কী বড়দা, মেজদা, জমাদার নর্দমা খুঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছে তো? এখনকার পুরপ্রধান তরুণ সাহা আসেন মোটরবাইকে— কুশল সংবাদ নেন। তিনি কথা বলেন কম, কিন্তু ঠিকঠাক কাজ করেন। রাস্তাঘাট সাফসুতরো হয় নিয়ম করে। কমিউনিটি হল তৈরি হয়েছে। সেখানে একটু সস্তায় বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান করা যায়। তবে ঝুপড়িমুক্ত করা যায়নি এখনও। আর টালা পার্কের ঐতিহ্যশালী মাঠটি আজও এবড়োখেবড়ো। ক্রিকেটের ফিল্ডাররা ছুটে এসে ক্যাচ ধরতে ভয় পায়। হোঁচট খেয়ে যদি হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আমার আশা, এটাও ঠিক হয়ে যাবে অচিরেই।

এই অঞ্চলটি এক সময়ে ছিল গুন্ডাপ্রবণ। আমাদের যৌবনকালে মাঝে মাঝে এ-পাড়ায় ও-পাড়ায় সোডার বোতল ছোড়াছুড়ি চলত। হই-হই, ছুটোছুটি, রক্তারক্তি। পুলিশের গাড়ি এলেই সব সুনসান। তবে এই সব লড়াইয়ের ফলে কেউ কেউ আজ প্রয়াত। এখন আবার তাদের নামে গড়ে উঠেছে শিবমন্দির, কালীমন্দির। আবার এ পাড়ায় হঠাৎ করে কোনও জমিতে দেবতার আবির্ভাবের কথা শুনেছি। মন্দিরও গড়ে উঠেছে। যাঁর জমিতে মন্দির গড়ে উঠল, তিনি ধনেপ্রাণে মারা গেলেন। শুনেছি এর পিছনে রাজনীতিকদের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়া ছিল।

আমাদের পাড়ায় কিছু নাটুকে মদ্যপ দেখেছি যাঁরা বেলগাছিয়া ব্রিজের ওপারে দিশি সরাপের দোকানে গিয়ে কয়েক পাঁইট টেনে নিয়ে টালা পার্কের ফুরফুরে হাওয়ায় পৌরাণিক নাটকের সংলাপ চর্চা করতেন। নাট্যশিল্পের সঙ্গে মদ্যপানের এই তীব্র সংযোগ এসেছিল কি প্রোফেশনাল বোর্ডের কিছু কিছু অভিনেতার দৌলতে? একদিন এক জন বিখ্যাত অভিনেতাকে অনুসরণ করে ওই দ্রব্যটির দোকানে গিয়ে দেখি নোটিসবোর্ডে ঝোলানো সতর্কবার্তা ‘Recitation not allowed’। আমার পাড়াতেই জীবন সায়াহ্ণে বসবাস করে গেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। তখন কবি নির্বাক। কাগজে আঁকিবুকি কাটেন শুধু। কবির জন্মদিনে টালা পার্কে লাইন লেগে যেত তাঁর পায়ে ফুল দেওয়ার জন্য।
আমিও গিয়েছি চারতলায় কবির ফ্ল্যাটে। পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করেছি এই টালা পার্কে।

আসলে আমাদের পাড়াটা ছিল সুখে-দুঃখে সবাই সবার অংশীদার। কে পরীক্ষায় ভাল ফল করল, কার শরীর ভেঙে পড়ছে, কার বাড়িতে সস্তায় বাগবাজার ঘাটের ইলিশ এল, কার ছেলে বিদেশে চলে গেল কেরিয়ার গড়তে— এ সব ছিল রোয়াকগুলির আলোচ্য বিষয়। আজ হিমানিবাড়ির দিকে চাইলে দেখি— ঝাঁ-চকচকে বহুতল, বেঙ্গল বক্সের কারখানার বিস্তৃত জায়গাটায় অচেনা সব মানুষজন। একটি একটি করে পুরনো বাড়ি ভেঙে পড়ছে। প্রোমোটাররা লোভীর মতো ঘুরছে এ-দিক ও-দিক। পুরনো বাড়িগুলির দিকে তাদের লোলুপ দৃষ্টি। একটা সময়ে প্রতিটি পাড়ার নিজস্ব পরিচয় ছিল। আজ সবই এক। কাউকে আর আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। আমাদের পাড়াটা এখনও তার কিছুটা বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বতন্ত্র। লোক বাইরে থেকে এলে এখনও বলে উত্তর কলকাতায় এমন একটা পাড়া আছে জানতাম না তো! কিন্তু এ আর ক’দিন! আজ প্রাতর্ভ্রমণে বেরোলে দেখি কত অপরিচিত সব মানুষজন। কথা চলছে অন্য ভাষায়। অন্য রকম কথা। কে জানে হয়তো আমার পাড়াটাও এমনি করে আরও অচেনা হয়ে যাবে এক দিন!

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন