আরও এক পুর নির্বাচনের প্রতীক্ষায় কলকাতা। এ শহর নিয়ে কী ভাবছেন ওঁরা?
Kolkata Culture

KMC Election 2021: পদবি শুনে বহু ‘শিক্ষিত’ সহনাগরিককেও দূরত্ব বাড়াতে দেখেছি

আগের থেকে সত্যিই অনেক ছিমছাম হয়েছে শহর, এ কথা মানতেই হবে। তবে শহরের ফুসফুস হিসাবে কিছু পার্কের খুব প্রয়োজন, যেখানে শিশুরা খেলতে পারে।

Advertisement

মেরুনা মুর্মু (অধ্যাপিকা)

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:৪১
Share:

ফাইল চিত্র।

এ শহরের বাসিন্দা হিসাবে এবং ইতিহাস পড়ানোর সুবাদে কলকাতা নিয়ে প্রথমেই যে কথা মনে হয় তা হল, এই শহরের ইতিহাস এবং সেই ঐতিহ্যের প্রতি অবহেলা। কলিকাতা, সুতানুটি, গোবিন্দপুর থেকে আজকের কলকাতা মহানগরীর তো প্রায় ৩৩৫ বছরের ইতিহাস রয়েছে। যে শহর ১৯১১ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক ভারতের রাজধানী ছিল, তার ইতিহাসকে কি রক্ষা করতে পেরেছি আমরা? যখন দেখি অতীতের ঐতিহ্যবাহী কোনও বাড়ি ভাঙা হচ্ছে বা অন্য কোনও স্মৃতি মুছে দেওয়া হচ্ছে, তা বড়ই কষ্টদায়ক মনে হয়। পুরুষ ‘আইকনদের’ ঐতিহ্য সংরক্ষণে যদি বা খানিকটা তৎপরতা চোখে পড়ে, সিস্টার নিবেদিতা, রানি রাসমণি বা অন্য অসংখ্য কৃতী নারীদের স্মৃতি সংরক্ষণে তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা গিয়েছে কি? তাঁদের নামে রাস্তাই বা ক’টা হয়েছে? অথচ ঐতিহ্য, ইতিহাসের যথাযথ সংরক্ষণ হলে পর্যটন-দ্রষ্টব্য হিসাবে তা থেকে সরকারের আয়ও হতে পারে।

Advertisement

পরিবেশের প্রশ্নটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই মুহূর্তে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে আবহাওয়া তার চেনা ছন্দ হারিয়েছে। সারা বছর ধরে ঘূর্ণিঝড়, বৃষ্টি ও জমা জল। তাই শহরের নিকাশি ব্যবস্থার প্রতি যেমন যত্নশীল হতে হবে, তেমনই জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যাতে আর কোনও মৃত্যুর ঘটনা না ঘটে, সে দিকেও নজর দিতে হবে। শহরের আনাচকানাচে গজিয়ে ওঠা বহুতলগুলি জল তুলে নেওয়ায় ক্রমশ নামছে ভূগর্ভস্থ জলস্তর। টালা বা গড়িয়ার মতো জলের ব্যবস্থা কেন মিলবে না ওই সব বহুতলে? পরিবেশ রক্ষার জন্য কিছু বাড়তি ব্যয় করে বিত্তবানেরা যাতে এই পরিষেবা পান, সেই ব্যবস্থা করতে হবে পুরসভাকেই। পূর্ব কলকাতা জলাভূমির মতো জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এলাকা আজ নগরায়ণের চাপে বিপন্ন। গাছ কমছে নির্বিচারে। তাই পুরসভাকে যে কোনও বাড়ি, রাস্তা বা অন্য কোনও কিছুর অনুমতি দেওয়ার আগে ভাবতে হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা কেমন শহর রেখে যাব।

আগের থেকে সত্যিই অনেক ছিমছাম হয়েছে শহর, এ কথা মানতেই হবে। তবে শহরের ফুসফুস হিসাবে কিছু পার্কের খুব প্রয়োজন, যেখানে শিশুরা খেলতে পারে। সন্তানেরা বাইরে থাকায় শহরের বহু বয়স্ক নাগরিক রয়েছেন, যাঁদের পার্কে বসে সমবয়স্কদের সঙ্গে সময় কাটাতে ভাল লাগে। তাঁদের নিরাপত্তার পরিবেশ, সমাজে মেলামেশার পরিসর তৈরি করে দেওয়াটাও জরুরি। বিভিন্ন কাজে, বিভিন্ন বয়সের মহিলাদের রাস্তায় বেরোনো যখন অবশ্যম্ভাবী, নারী হিসাবে নিরাপত্তার সঙ্গে শহরে যথেষ্ট ব্যবহারযোগ্য শৌচাগারের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।

Advertisement

বাহ্যিক পরিকাঠামোয় ভর দিয়ে এ শহর কল্লোলিনী তিলোত্তমা থেকে ‘স্মার্ট সিটি’ হয়ে উঠেছে বটে। তবে বসবাসের অভিজ্ঞতায় খাতায়কলমে আধুনিকতার অনেক উপাদান এই শহরে থাকলেও, মানসিকতায় আধুনিক হতে এখনও বেশ কিছুটা বাকি আছে। উঁচু উঁচু বহুতল, উড়ালপুল, শপিং মলের নীচে বাস করা সহনাগরিকদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। পুরসভার দু’টি গুরুত্বপূ্র্ণ পরিষেবা হল স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। বিত্তহীন মানুষ, যাঁদের অধিকাংশেরই দামি স্কুল বা হাসপাতালে যাওয়ার সামর্থ্য নেই, তাঁদের ভরসার জায়গা হতে পারে পুর স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও স্কুলগুলি। অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল শ্রেণির মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটালে তা সামগ্রিক নগরজীবনের পক্ষেই ভাল হবে। ‘ওঁদের’ শ্রমে নির্ভর করেই কিন্তু আমাদের নাগরিক জীবন চলে। অথচ বাস্তব হল, ‘উচ্চ কোটির’ বাসিন্দা বলে আত্মকেন্দ্রিক জীবন গোছাতে গিয়ে ফুটপাতবাসী, শিকড়হীন পরিযায়ী শ্রমিক, পথশিশু, ঝুপড়িতে থাকা পরিচারিকাদের উচ্ছেদ করার প্রকল্পে আমরা শামিল হয়ে পড়ছি। পছন্দ না হলে অনেককেই সহনাগরিক হতে দিই না আমরা। অভিজাত আবাসনে পদবি শুনে বহু ‘শিক্ষিত’ সহনাগরিককেও দূরত্ব বাড়াতে দেখেছি। জাতপাতের মতো একই অভিজ্ঞতা হয় অনেক সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীর, একা মানুষ, এলজিবিটি সম্প্রদায়ভুক্ত, অর্থাৎ যৌন সংখ্যালঘু মানুষের। এই ‘স্মার্ট সিটি’র যুগেও শহরে একটা অস্থায়ী ঠিকানা পেতে মাথা খুঁড়ে মরতে হয় এমন পরিচয় বহনকারী মানুষদের। তাই পুর প্রশাসনকে এ ব্যাপারে আরও তৎপর ও সহমর্মী হতে হবে।

কারণ ইতিহাস বলে, সবাইকে আপন করে না নিতে পারলে কিন্তু তা আদতে শহরের অস্তিত্বকেই সঙ্কটে ফেলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন