কার জুতোয় কে গলাবে পা, প্রশ্নে পাদুকা-প্রকল্প

কোলে রাখা বাক্স খুলতেই যে এমন মনখারাপ হয়ে যাবে, ভাবতেই পারেনি চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া ময়না মণ্ডল। পুরসভার স্কুলের জুতো দেওয়ার অনুষ্ঠানে উপহারের মোড়ক খুলতেই দেখা গেল, চার নম্বরের বদলে রয়েছে দু’নম্বরের জুতো। কী হবে এ বার? মুখভার করে ময়নার উত্তর, ‘‘আমি তো পরতে পারব না। ঘরে ছোট বোন রয়েছে। ওকেই গিয়ে দিয়ে দেব।’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৪৭
Share:

কোনও ছেলে পেয়েছে মেয়েদের জুতো (বাঁ দিকে), কারও জুতো আবার ছোট মাপের। বুধবার, পুরসভার অনুষ্ঠানে। — নিজস্ব চিত্র

কোলে রাখা বাক্স খুলতেই যে এমন মনখারাপ হয়ে যাবে, ভাবতেই পারেনি চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া ময়না মণ্ডল। পুরসভার স্কুলের জুতো দেওয়ার অনুষ্ঠানে উপহারের মোড়ক খুলতেই দেখা গেল, চার নম্বরের বদলে রয়েছে দু’নম্বরের জুতো। কী হবে এ বার? মুখভার করে ময়নার উত্তর, ‘‘আমি তো পরতে পারব না। ঘরে ছোট বোন রয়েছে। ওকেই গিয়ে দিয়ে দেব।’’

Advertisement

পুরসভার দেওয়া সেই ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খুলতেই মনখারাপ তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র শেখ এহসানেরও। বাক্স খুলতেই দেখে সেখানে রয়েছে মেয়েদের স্কুলজুতো। ‘‘এই জুতো নিয়ে আমি কী করব? এটা তো মেয়েরা পরে। আমার বাড়িতে পড়েই থাকবে এটা,’’ উত্তর এহসানের। শুধু এই দু’জন নয়, জুতো নিতে এসে ভোগান্তির মুখ দেখতে হল পড়ুয়াদের অধিকাংশকেই। যদিও কলকাতার মেয়রের মতে, ‘‘এটি একটি ছোট্ট ঘটনা। ঠিক মাপের জুতো সময়েই পৌঁছে যাবে।’’

বুধবার উত্তম মঞ্চে কলকাতা পুরসভার স্কুলগুলির প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়াদের স্কুলজুতো বিলি অনুষ্ঠানে শেষমেশ এ ভাবেই লেজেগোবরে হতে হল কলকাতা পুরসভা কর্তৃপক্ষকে। যদিও এমনটা যে হতে পারে, আশঙ্কা ছিল আগেই। ইতিমধ্যেই স্কুলপড়ুয়াদের সাইকেল বিলি করতে গিয়ে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে। সাইকেল নিয়ে রাস্তায় নামার আগেই নাজেহাল হতে হয়েছে পড়ুয়াদেরও। তারই মধ্যে গত মাসে পানাগড়ে মাটি উত্সবে যাওয়ার পথে রাজ্যের প্রাথমিক স্তরের পড়ুয়াদের স্কুলের জুতো দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিধানসভা ভোটের আগে তাই নতুন করে জুতো বিলির এই চমকদারি দেখে স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয়ে যায় জল্পনা।

Advertisement

যদিও কলকাতা পুরসভা কর্তৃপক্ষের কথায়, এই জুতো দেওয়ার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত প্রকল্পের কোনও সম্পর্কই নেই। প্রতি বছরই পুরসভার পক্ষ থেকে পড়ুয়াদের পোশাক, ব্যাগ, খাতা ইত্যাদি দেওয়া হয়। তবে জুতো দেওয়া এই প্রথম। এবং গোড়াতেই গণ্ডগোল।

গণ্ডগোলের সূত্রপাত হল কলকাতা পুরসভার হাত ধরেই। কলকাতা পুরসভার মোট ২৭১টি স্কুলের ১২৫ জন পড়ুয়ার হাতে স্কুলজুতো তুলে দেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুখ্য সচেতক রত্না শূর, মেয়র পারিষদ অভিজিত্ মুখোপাধ্যায় (শিক্ষা), দেবাশিস কুমার (উদ্যান), রতন দে (রাস্তা), চেয়ারপার্সন মালা রায় প্রমুখ। পড়ুয়াদের হাতে তুলে দেওয়া উপহারের মধ্যে ছিল স্কুলের পোশাক, ব্যাগ, খাতা, পেন্সিল, রবার, পেন্সিল বাক্স এবং জুতো-মোজা। সেই জুতো নিয়েই শুরু হয় সমস্যা।

১০০ জন পড়ুয়ার ক্ষেত্রেই দেখা গেল, যার যা পায়ের মাপ, সেই মাপের জুতো পায়নি পড়ুয়া। কোথাও আবার ছেলেদের বাক্সে রয়েছে মেয়েদের জুতো। সেই নিয়েই খুদে পড়ুয়াদের কান্না, একটু বড় ক্লাসের পড়ুয়াদের হাসাহাসি, কোথাও আবার একরাশ মনখারাপ। কিন্তু এমন হল কেন? নিয়ম অনুযায়ী জুতো বিলি করার আগে প্রতিটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল পড়ুয়াদের পোশাক এবং জুতোর মাপ। স্কুল থেকে প্রতিটি পড়ুয়ার জুতোর মাপ পাঠানোও হয় পুরসভায়। পুরসভা সূত্রে খবর, ২৭ হাজার জোড়া জুতো-মোজা তৈরির জন্য ৪৯ লক্ষ টাকার বরাত পেয়েছিল সরকারি সংস্থা ‘বঙ্গশ্রী’। তা হলে এই হেরফের কেন? মেয়র পারিষদ (শিক্ষা) অভিজিত্ মুখোপাধ্যায়ের সাফাই, ‘‘আমরা সব স্কুল থেকেই মাপ চেয়ে পাঠিয়েছিলাম। কোনও ভাবে এক স্কুলের ঘাড়ে অন্য স্কুলের পড়ুয়াদের নাম চেপে যাওয়ায় সমস্যা হয়েছে।’’ কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেই মেয়র পারিষদই (শিক্ষা) হঠাত্ সুর বদলে আঙুল তুলেছেন খুদে পড়ুয়াদের উপরেই।

‘‘হেরফের কীসের আবার? পড়ুয়ারা তো নিজেরা জুতো পাল্টে নিয়েছে!’’ এমনই আশ্চর্য সাফাই দেন মেয়র পারিষদ (শিক্ষা) অভিজিত্ মুখোপাধ্যায়। এ দিনের জুতো বণ্টনকে ‘প্রতীকি’ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘আমরা স্কুলের পাঠানো মাপ অনুযায়ী জুতো বিলি করেছি। আমাদের তরফে কোনও ভুলই হয়নি। ছাত্রছাত্রীরা জুতো পাওয়ার পরে নিজেরা পাল্টাপাল্টি করেছে।’’

অভিজিত্‌বাবুর বক্তব্যের উল্টো পথেই হেঁটেছেন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। বিভ্রান্তির কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘‘প্রায় ২৭ হাজার জোড়া জুতোর বরাত দেওয়া হয়। আমাদের হাতে সময়ও কম। তাই কিছু ভুল হতেই পারে। এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়।’’ যারা ভুল মাপের জুতো পেয়েছে, তাদের ঠিক মাপের জুতো পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন