পুর-উদ্বেগ

শহরে আলোর বাহার, বিল মেটাতে চোখে অন্ধকার

আলোর বন্যায় ভাসছে শহর, আর চড়চড়িয়ে বাড়ছে কলকাতা পুরসভার বিদ্যুৎ বিল। পাড়ায় পাড়ায় ত্রিফলা আলো লাগানোর আগে শহরের রাস্তায় আলো জ্বালাতে পুরসভার যেখানে মাসে সাত কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল হত, এখন তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুনের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে। টাকার অঙ্কে যা মাসে প্রায় ১৩ কোটি টাকা।

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায় ও পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৬ ০১:১১
Share:

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

আলোর বন্যায় ভাসছে শহর, আর চড়চড়িয়ে বাড়ছে কলকাতা পুরসভার বিদ্যুৎ বিল। পাড়ায় পাড়ায় ত্রিফলা আলো লাগানোর আগে শহরের রাস্তায় আলো জ্বালাতে পুরসভার যেখানে মাসে সাত কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল হত, এখন তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুনের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে। টাকার অঙ্কে যা মাসে প্রায় ১৩ কোটি টাকা।

Advertisement

এখানেই শেষ নয়, এর পরেও জল সরবরাহ ও নিকাশি পাম্প চালাতে আরও ১৯ কোটি টাকা বিল মেটাতে হয় সিইএসসি-কে। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে পুরসভার কোষাগার থেকে ৩২ কোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিল মেটাতে। কিন্তু তার পরেও যে ভাবে প্রতিদিন পুরসভা এলাকায় নানা ধরনের রঙিন আলোর বহর বাড়ছে, তাতে আগামী দিনে বিল আরও বাড়বে বলেই মনে করছেন পুর-কর্তাদের একাংশ। আর তাতেই মাথায় হাত পড়েছে তাঁদের। যদিও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আলোর জন্য বিদ্যুৎ বিল বাড়ছে এমনটা নয়। কেন বাড়ছে তা নিয়ে সিইএসসি কতৃর্পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে।’’

পুরসভারই পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে শহরে ১ লক্ষ ৩০ হাজার সোডিয়াম ভেপার, এক লক্ষ ২০ হাজার মেটাল হ্যালাইড-সহ ২০ হাজার ত্রিফলা আলো রয়েছে। রয়েছে উচ্চবাতিস্তম্ভ যুক্ত হাইমাস্টও। যেখানে এক সঙ্গে ৬ থেকে ১০টি পর্যন্ত অধিক ক্ষমতাবিশিষ্ট (প্রায় ৪ হাজার ওয়াট) বাতি লাগানো হয়। তাতে বিদ্যুতের খরচও অনেক। ওই ধরনের হাইমাস্টের সংখ্যা এখনই ১০০টি। আরও ২৫টি বসানোর
জন্য রাজ্য সরকারের অনুদান
পেয়েছে পুরসভা।

Advertisement

পুরসভার এক আমলা জানান, এ সব তো ছিলই। এখন আলোর উপরেও আলো বসছে। অতি সম্প্রতি ত্রিফলা বাতিস্তম্ভের গা জড়িয়ে লাগানো হচ্ছে এলইডি আলো। তা অবশ্য আলো দিতে নয়, শহর সাজানোর জন্য। রাস্তার ধারে ত্রিফলার গায়ে পেঁচানো ওই এলইডি আলো এখনই ৭ হাজার বাতিস্তম্ভে লাগানো হয়েছে। আরও লাগানোর কাজ চলছে। এর সঙ্গে রয়েছে পুরসভার বাতিস্তম্ভ থেকে চুরি করে ফুটপাথে দোকান চালানোর কাজও। যা ক্রমশই বাড়ছে বলে জানাচ্ছেন
পুর-ইঞ্জিনিয়ারেরাই।

বাতির সংখ্যাতেই শেষ নয়, তা কতক্ষণ জ্বালানো থাকে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে পুরমহলে। পুর-আধিকারিকদের কথায়, প্রায়শই দেখা যায় সকাল হয়ে যাওয়ার পরে বা সূর্য ডোবার অনেক আগে থাকতেই বাতিস্তম্ভে আলো জ্বলতে থাকে। দক্ষিণে আলিপুর, বেলভিডিয়ার রোড-সহ সংযোজিত কলকাতার বিভিন্ন এলাকা এবং উত্তরে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোড, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মতো রাস্তাতেও প্রায়সই এমন ঘটনা ঘটে বলেই অভিযোগ। তবে সবটাই যে পুরসভার গাফিলতি তা নয়, সিইএসসি-র দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন অনেকে।

পুরকর্তাদের বক্তব্য, প্রতিটি বাতিস্তম্ভে টাইমার মেশিন রাখা হলেও অনেক রাস্তায় আলো নেভানো যায় না। যান্ত্রিক ত্রুটিকেই এর কারণ হিসেবে দেখানো হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন মিটারে ঠিক মতো রিডিং নেওয়া হচ্ছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে পুরকর্মীদের। পুরসভার বাজারগুলির মিটারে গণ্ডগোলের কথাও একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না অনেকেই। এর পিছনে সিইএসসি-র এক শ্রেণির কর্মীর হাত থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়ে পুরসভার ঘাড়ে বেশিরভাগ বিদ্যুতের বিল চাপানো হয়ে থাকে বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।

সিইএসসি অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। সংস্থা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, কলকাতা পুরসভা এলাকায় যতগুলি মিটারের মাধ্যমে বাতিস্তম্ভগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, তার সংখ্যা প্রায় ৮৯০০। প্রতিটি বাতিস্তম্ভের গায়ে লাগানো টাইমারগুলি স্বয়ংক্রিয় ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। মিটার রিডিংও হয় স্বয়ংক্রিয় ভাবেই। সিইএসসি-র এক কর্তার কথায়, বাতিস্তম্ভে আলো কখন জ্বলবে বা নিভবে তা পুরসভার সঙ্গে কথা বলেই টাইমারে সময় ঠিক করা হয়। সেই সময় ধরেই রাস্তায় আলো জ্বলে-নেভে। তাই অসময়ে আলো জ্বলার কোনও কারণ থাকতে পারে না। সিইএসসি-র দাবি, টাইমারগুলি সব সময়ে তাদের নজরদারির মধ্যে থাকে। কোথাও যান্ত্রিক ত্রুটির খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে তা সারিয়ে দেওয়া হয়। মিটার রিডিংয়ের ক্ষেত্রেও সংস্থার বক্তব্য, কোনও অভিযোগ থাকলে তাঁরা খতিয়ে দেখতে পারেন। যেমন অন্য গৃহস্থ গ্রাহকদের ক্ষেত্রে তাঁরা
করে থাকেন।

সিইএসসি-র এক কর্তার কথায়, ‘‘বিদ্যুৎ পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি জায়গায় পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করি। কলকাতা পুরসভাও আমাদের গ্রাহক, তাদের উন্নত পরিষেবা দেওয়াই আমাদের কাজ।’’ তবে পুরনো মিটারের ফলে বিদ্যুতের বিল যে বাড়ছে তা অস্বীকার করেননি মেয়রও। শোভনবাবু বলেন, ‘‘মিটারের গলদ রুখতে ডিজিটাল মিটার
বসানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ নিয়ে পুরসভা ও সিইএসসি-র মধ্যে আলোচনাও হয়েছে।

কলকাতা শহরে বিদ্যুতের জোগান দেয় সিইএসসি। পুরসভার তথ্য বলছে, প্রতি মাসে প্রায় ৪ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। এর মধ্যে প্রায় দেড় কোটি ইউনিট লেগে যায় আলো জ্বালাতেই। বাকি বিদ্যুৎ লাগে পুরসভার অন্যান্য পরিষেবা চালু রাখতে। তাই খরচ বাঁচাতে পুর-আধিকারিকেরা এখন সৌরশক্তির ব্যবহারের দিকে জোর দিচ্ছেন। কারণ শহর জুড়ে আলো জ্বালিয়ে পুরসভার ঘাড়ে যেমন বিলের বোঝা বাড়ছে, একই সঙ্গে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও। সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়ালে খরচ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।

উদাহরণ হিসেবে এক আধিকারিক জানিয়েছেন, দেশপ্রিয় পার্কে আলো বাবদ আগে সিইএসসি-র বিদ্যুৎ বিল হত মাসে ৩৯ হাজার টাকা। ওই পার্কে সৌর আলো লাগানোর পরে এখন বিল ওঠে মাসে গড়ে ৮ হাজার টাকার মতো। হাতে-গরম এই ফল পেয়ে পুরসভা এখন আরও ১৬টি পার্কে সৌর আলো লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু তাতেও ঠিক আশ্বস্ত হতে পারছেন না পুর-কর্তারা। শহর জুড়ে ঘটা করে আলোর লাগানোর বহর কমাতে না পারলে বিদ্যুৎ বিলে লাগাম টানা যাবে না। কিন্তু সেই কাজে বাধা দেবে কে? তার উত্তর অবশ্য পুর-কর্তাদের কেউ
দিতে পারেননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন