নাকতলার সেই বিতর্কিত জমি কিনে নিচ্ছে রাজ্য সরকার। আগামী ১১ এপ্রিলের মধ্যে জমির দাম বাবদ প্রথম দফায় ৬ কোটি টাকা আদালতে জমা দেবেন কেএমডিএ কতৃর্পক্ষ। বুধবার হাইকোর্টের নির্দেশের প্রেক্ষিতেই ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান কেএমডিএ-র চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার গুলাম আনসারি। তিনি জানান, জমিটি দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে কী হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আদালতের রায়ের কপি হাতে আসার পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নাকতলায় ২৫৩সি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রোডের ওই ঠিকানায় প্রায় ৪০ কাঠা জমি রয়েছে। জমিটির মালিক লীনা দত্ত নামে ভবানীপুরের বাসিন্দা এক মহিলা। ১৯৭২ সালে কলকাতা মেট্রোপলিটন ওয়াটার অ্যান্ড স্যানিটেশন অথরিটি (কেএমডব্লিউএসএ) তাঁর ওই জমি রিকুইজিশন করেছিল। কিন্তু কেএমডব্লিউএসএ জমিটি অধিগ্রহণ করেনি। জমির দাম বাবদ কোনও টাকাও দেয়নি মালিককে। ইতিমধ্যে ওই জমি দখল করে একটি ক্লাবও গড়ে ওঠে। বর্তমানে যার মাথায় স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর সুস্মিতা দামের স্বামী তৃণমূল নেতা ভাস্কর দাম। জমির একটি অংশ বিয়েবাড়ি হিসেবে ভাড়া দিচ্ছিল ক্লাব। জমিতে একটি মাল্টিজিম-এরও উদ্বোধন করেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। জমির মালিকানা ফিরে পেতে ২০১৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন লীনাদেবী। বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের এজলাসে ওই মামলা ওঠে। মামলার আবেদনে তিনি বলেন, ওই জমি কেএমডব্লিউএসএ দীর্ঘদিন অন্য কাজে ব্যবহার করেছে। জমির ভাড়া বাবদ তাঁকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।
২০১৫ সালে বিচারপতি ভট্টাচার্য নির্দেশ দেন, জমির মালিককে ভাড়া বাবদ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিচারপতি আরও নির্দেশ দেন, ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন কালেক্টর ক্ষতিপূরণের টাকা মেটাবেন। জমির দখল ফেরাতে ও জমি মালিককে ক্ষতিপূরণ দিতে আদালত রিসিভার নিযুক্ত করে। তার পরেও জমির দখল না পেয়ে ফের হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন লীনাদেবী। গত ৮ অক্টোবর হাইকোর্ট নিযুক্ত বিশেষ অফিসার বা রিসিভার জমির দখল ও ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পেশ করে আদালতে। তার ভিত্তিতে ৯ অক্টোবর বিচারপতি ভট্টাচার্য নির্দেশ দেন, ১৬ অক্টোবরের মধ্যে লীনাদেবীকে ৫০ লক্ষেরও বেশি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হবে এবং ১৮ ডিসেম্বর তাঁকে জমির দখল ফেরাতে হবে। জমি দখলমুক্ত করার সময়ে সেখানে কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে থাকতে নির্দেশ দেন বিচারপতি। হাজির থাকতে বলেন ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন কালেক্টর, কেএমডব্লিএসএ,পুরসভা এবং কেএমডিএ-র প্রতিনিধিদেরও।
আদালতের নির্দেশ মতো ১৮ ডিসেম্বর সকালে ঘটনাস্থলে পৌঁছন পুলিশ কমিশনার। সঙ্গে কলকাতা পুলিশের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্তা এবং বিরাট পুলিশ বাহিনী। হাজির ছিলেন আদালত নিযুক্ত বিশেষ অফিসার রবিশঙ্কর দত্ত-সহ বিভিন্ন সরকারি অফিসারেরা। কিন্তু উচ্ছেদের দায়িত্বে থাকা কলকাতা পুরসভার কোনও কর্মী উপস্থিত না থাকায় জমি দখলমুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরুই করা যায়নি। পুলিশ কমিশনারের সামনেই নাকতলার ক্লাবের কর্তা ভাস্করবাবু জমি থেকে ক্লাব সরানো হলে আত্মহত্যার হুমকি দেন। এ ঘটনায় বেজায় চটে যান বিচারপতি। ২৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট জানায়, ক্লাবের হাত থেকে জমিটি দখলমুক্ত করতে না পারলে প্রয়োজনে সেনা নামিয়ে সেটি জমির মালিকের হাতে তুলে দেওয়া হবে। তখনই রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিচারপতি ভট্টাচার্যের আদালতে জানান, জমির মালিক ন্যায্য ক্ষতিপূরণই পাবেন। রাজ্য নিয়ম মেনেই ওই জমির পুরোটাই অধিগ্রহণ করবে।
তা জেনে বিচারপতি ভট্টাচার্য এজি-কে বলেন, ‘‘আমি বারবারই রাজ্যকে সুযোগ দিয়ে জানিয়েছি, প্রয়োজন হলে নিয়ম মেনে জমিটি অধিগ্রহণ করে নিক তারা। কিন্তু সরকার বা কলকাতা পুরসভা কেউই নিয়ম মেনে জমিটি অধিগ্রহণ করেনি। উল্টে স্থানীয় একটি ক্লাব দাবি করছে, ওই জমিতে তাদের অধিকার রয়েছে, কারণ তারা সত্তরের দশক থেকে সেখানে রয়েছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না।’’ ইতিমধ্যে বিষয়টিতে তৃণমূলের কয়েক জন নেতা-মন্ত্রীর জড়িয়ে থাকার ইঙ্গিত মেলায় শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে তাঁদের সতর্ক করা হয়েছিল বলেও দলের অন্দরে খবর।
বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যের আদালতে মামলাটি উঠলে রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এজি) জয়ন্ত মিত্র জানান, ওই জমির দাম বাবদ ১১ এপ্রিলের মধ্যে কেএমডিএ আপাতত ৬ কোটি টাকা জমা দিতে চায়। তা শুনে বিচারপতি ভট্টাচার্য এজি-কে নির্দেশ দেন, হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে ওই টাকা জমা রাখতে হবে। রেজিস্ট্রার রাষ্ট্রায়ত্ত কোনও ব্যাঙ্কে ওই টাকা জমা রাখবেন।
জমির মালিক লীনা দত্তের আইনজীবী কিশোর দত্ত আদালতে জানান, ওই জমির বাজারদর কমবেশি ১৩ কোটি টাকা। তা ছাড়া, ওই জমি এখনও খাস হয়নি। কী ভাবে কতখানি সরকার খাস করবে, তা-ও তাঁর মক্কেলকে জানানো হয়নি। ঐকমত্য হয়নি জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতি নিয়েও। এজি আদালতে জানান, এ সব দু’পক্ষ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মিটিয়ে নেবে। মামলার পরবর্তী শুনানি হবে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে।
বুধবার হাইকোর্টের নির্দেশ জেনেই জমির দাম হিসেবে ৬ কোটি টাকা আগাম জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেএমডিএ। সংস্থার সিইও গুলাম আনসারি জানান, জমির মোট দাম কত হবে, তা আদালত জানিয়ে দিলে বাকি টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু যে তৃণমূল নেতা (১০০ ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুস্মিতা দামের স্বামী ভাস্কর দাম ) ওই জমিতে ক্লাব করেছেন, তার কী হবে? আনসারি বলেন, ‘‘পুরো বিষয়টা আদালতে। যেমন নির্দেশ হবে সেই মতো কাজ হবে।’’ এ দিন জমি গ্রহণে টাকা জমার দেওয়ার নির্দেশ শুনে ভাস্করের বক্তব্য, ‘‘কেএমডিএ বা কর্পোরেশন আগে অধিগ্রহণ করুক। তার পরে দেখা যাবে। তখন মানুষ যা বলবেন, তা-ই হবে।’’ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এ দিন আর কিছু বলতে চাননি।