মশা মারতে নেমে পড়ল পড়ুয়ারাও। সল্টলেকের সি এ স্কুলে।
ডেঙ্গিতে একটি মৃত্যু আর তাকে কেন্দ্র করে তুমুল টানাপড়েন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর এবং কলকাতা পুরসভার মধ্যে।
টানাপড়েনের কারণ, মৃতের ঠিকানা। তিনি কলকাতার বাসিন্দা কি না, তা নিয়েই বেধেছে কাজিয়া।
স্বাস্থ্য দফতরের খাতায় মৃতার ঠিকানা: ১০/৮ কে বি ফার্স্ট লেন, কলকাতা ৭০০০১১। থানা, নারকেলডাঙা। ওই তথ্য অনুযায়ী এই মরসুমে এটাই কলকাতা শহরে ডেঙ্গিতে মৃত্যুর প্রথম ঘটনা। কিন্তু কলকাতা পুরসভা জোর গলায় দাবি করছে, মৃতা আনিসা খাতুন আদতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরের বাসিন্দা। ফলে একে কোনও ভাবে কলকাতায় এক জনের মৃত্যু বলে ধরা যাবে না। গত ২৯ জুলাই রাতে মধ্য কলকাতার এক নার্সিংহোমে ২১ বছরের আনিসার মৃত্যু হয়। শুক্রবার তার রক্তপরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে বলে জানিয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কথায়, ‘‘কলকাতা পুরসভা কী বলছে জানি না। তবে আমাদের কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী, ওই তরুণীর বাড়ি নারকেলডাঙা থানা এলাকায়।’’ তা হলে কি কলকাতা পুরসভা নিজেদের উপরে চাপ কমাতে তথ্য গোপন করতে চাইছে? উত্তর দেননি পুরকর্তারা।
তবে, স্বাস্থ্য দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা (জনস্বাস্থ্য ও সংক্রামক ব্যাধি) কমলকৃষ্ণ পতি বলেন, ‘‘কলকাতা পুরসভা ক্রমাগত এটাই বলে গিয়েছে যে, মৃতার বাড়ি এই শহরের বাইরে। কিন্তু আমরা টানা চার দিন ধরে খোঁজার পরে তাঁর আসল ঠিকানা বার করেছি।’’
এক দিকে যখন এই টানাপড়েন, তখন কলকাতা সংলগ্ন সল্টলেকে হু হু করে বাড়ছে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা। ইতিমধ্যে সেখানে দু’হাজারেরও বেশি মানুষ জ্বরে আক্রান্ত। তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত ৪৯ জনের শরীরে ডেঙ্গির ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে। সল্টলেকের যে স্কুলে ডেঙ্গিতে দুই পড়ুয়ার মৃত্যু হয়েছে, সেখানে শুক্রবারও পঠনপাঠন শুরু করা যায়নি। স্কুল-কর্তৃপক্ষ বলছেন, স্কুল পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত করে তবেই খোলা হবে।
ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণের কাজে কোনও ঢিলেমি যাতে না হয়, তার জন্য ছুটির দিনেও পুরসভার স্বাস্থ্য দফতর খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ এ দিন জানান, ডেঙ্গি আক্রান্তের চিকিৎসা এবং রক্ত পরীক্ষা করার জন্য শহরের দু’টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা হচ্ছে। এর একটি উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে, অন্যটি দক্ষিণ কলকাতার লায়েলকায়। ই এম বাইপাসের ধারে তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে এ দিন ডেঙ্গি ও ম্যালেরিয়াবাহী মশা দমনে অভিযান চালায় পুরসভা। মেয়র পারিষদ অতীনবাবু জানান, মেডিকা এবং পিয়ারলেস হাসপাতালে গোটা কয়েক স্থানে জমা জলে মশার লার্ভা মিলেছে। ওই দুই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।
বিধাননগর পুরসভার বিরুদ্ধে অবশ্য অভিযোগ উঠেছে, রোগ মোকাবিলায় যতটা তৎপরতা দেখানোর কথা, তারা তা দেখাচ্ছে না। যদিও পুরসভার দাবি, জোরকদমে কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ বাসিন্দার অভিযোগ, পুরকর্মীরা রাস্তায় ঘুরে কোনওমতে মশার তেল স্প্রে করে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু ফাঁকা প্লট, বাড়ির পিছনের অংশে ঝোপজঙ্গলে জমে থাকা জল সরানো, জঙ্গল সাফ করা কিংবা ধোঁয়া দেওয়ার কাজ হচ্ছে না। বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুরকর্মীরা তাঁদের জানিয়েছেন, বাড়ির ভিতরে কাজ করার নির্দেশ নেই।
সিএফ ব্লকে একটি বাড়িতে জমানো জল। নজর নেই পুরসভার। শুক্রবার। — স্নেহাশিস ভট্টাচার্য ও শৌভিক দে
প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে ভিত্তিহীন নয় তা এ দিন সল্টলেকের একাধিক ব্লকে ঘুরে দেখা গেল। কোথাও বাড়ির পিছনে ফাঁকা অংশ ঝোপজঙ্গল আর জলে ভরা। সেখানে মশার লার্ভা। বাড়ির বারান্দায় ফুলের টবে জল ভর্তি। কোথাও আবার ব্লকের মধ্যে বেশ কয়েকটি ফাঁকা জমি। সেখানেও জঙ্গল, কাদা, আবর্জনার স্তূপ। যেখানে সেখানে বর্ষার জল জমে রয়েছে। কোথাও আবার দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ বাড়ির বারান্দায় জমে রয়েছে জল। সাফ করার কেউ নেই।
অথচ, দুই পড়ুয়ার মৃত্যুর পরে সল্টলেকের স্কুলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক হয়। হাজির ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক অন্তরা আচার্য, বিধানগরের মেয়র সব্যসাচী দত্ত প্রমুখ। বৈঠকের পরে জেলাশাসক জানান, যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করা হবে। স্কুলগুলিতে নিয়মিত পরিদর্শন করবেন পুরকর্মীরা। রাজারহাট-নিউটাউনে ২৭টি ওয়ার্ডে অতিরিক্ত ১০৮ জন কর্মীকে কাজে লাগানো হবে। কার্যক্ষেত্রে অবশ্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। মেয়র সব্যসাচী দত্ত অবশ্য বলেছেন, ‘‘বাসিন্দারা চাইলে নিশ্চিত ভাবেই পদক্ষেপ করতে হবে কর্মীদের। বাড়ি বাড়ি গিয়েই জমা জল ফেলতে হবে বা ধোঁয়া দিতে হবে।’’