বিকোচ্ছে মোদক। সোমবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
তিনি আর আগমনী গানের শিশুটি নেই। গণেশকে ভুলেও ‘গানুশ’ বলে ডাকে না এ বাঙালি। সে এখন ‘গণপতি বাপ্পা’র ভক্ত হয়েছে।
শহরের ময়রা-হলওয়াইদের ঠেকে অবধি তার প্রতিফলন চোখে পড়ছে। সন্দেশ বা রসগোল্লা এ ক’দিন খানিক ব্যাকফুটে। উৎসবের আবহে লাড্ডু-মোদকের জয়জয়কার। সোমবার দুপুরে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তা-ই ভবানীপুরের মিষ্টি-বিপণিতে হাজির ঢাকুরিয়ার সুতপা রায়চৌধুরী বা কাঁসারিপাড়ার অমর বসু। সুতপার বাড়ির পুজো হলেও অমরবাবুরা মন্দারমণির রিসর্ট, দক্ষিণ কলকাতায় ক্যুরিয়রের কারবার সামলান। পেল্লায় লাড্ডু বা খানিকটা মোমোর আদলের চূড়াকৃতি মিষ্টি মোদকের ভাগে ফাঁকি দিয়ে ‘সিদ্ধিদাতা’কে চটানোর ‘রিস্ক’ নেবেন না।
সোদপুরের হার্ডওয়্যার কারবারি স্বরূপ ঘোষ ভাল লাড্ডু, মোদকের খোঁজে সল্টলেকের খানদানি হলওয়াইয়ের দ্বারস্থ। সুন্দরবনের রিসর্ট মালিক স্বরূপ ঘোষও চিন্তায় ছিলেন। সল্টলেক থেকে শ’খানেক লাড্ডু, মোদক ঘোর বাদলায় পুজো শুরুর আগে পৌঁছতেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। হাতিবাগান-গড়িয়াহাটের গয়নার দোকানের কর্তা বলছিলেন, ‘‘৫০ বছরের দোকানে আগে পয়লা বৈশাখ ছাড়া গণেশকে ডাকাডাকির রেওয়াজ ছিল না। বছর তিনেক হল, মন দিয়ে পুজোটা করছি। মোদকের সঙ্গে তখনই পরিচয়।’’ শ্রীরামপুরের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী নিরুপম সরকার এ পুজোয় তুলনায় ‘ভেটারেন’। তিনি বলছেন, ‘‘লাড্ডু থাকলেও নানা কিসিমের মোদক আগে অত মিলত না।’’
বাড়ির গণেশ পুজোয় সকন্যা মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে। সোমবার। ছবি: শৌভিক দে।
তবে এ মিষ্টি স্বাদে মোটেও তত অচেনা নয়। খাস মরাঠামুলুকের সৃষ্টি উক্রিচা মোদক আদতে বাঙালির ভাপা বা সেদ্ধ পিঠেরই জাতভাই। পাতলা চালের গুঁড়ির পটির ভিতরে ঘি-সুরভিত নারকোল পুরের সমারোহ। কোনও কোনও বাঙালি মিষ্টি কারবারি পুণের জোশি সুইট্স, চিতলে বন্ধু, কাকা হলওয়াইদের মতো হেভিওয়েটদের কাছে নাড়া বেঁধে আস্তিন গুটিয়ে মাঠে নেমেছেন। বলরাম মল্লিক পরিবারের কর্তা সুদীপ মল্লিক বা ফেলু ময়রার ঘরের অমিতাভ মোদক বলছিলেন, বাঙালি পিঠে সাবেক মাটির সরায় তৈরির রেওয়াজ! মরাঠি সৃষ্টি, গরম জলের ভাপে হয়। ঘিয়ের বাহুল্যে মরাঠি স্রষ্টা বাঙালির থেকে আলাদা।
আদতে নাগপুরের মেয়ে, অধুনা টালিগঞ্জবাসী সিল্কি সরকার নিজের অফিসের পুজোয় নিজে শতাধিক মোদক গড়েন। সকলের অবশ্য এ ধকল সইবে না। তাই দোকানে দোকানে ময়রাদেরই পোয়াবারো। ধ্রুপদী উক্রিচা মোদকের বাইরেও বিচিত্র কারিকুরি। পশ্চিম বা উত্তর ভারতের নানা ডিজাইনার মোদকও এখন কলকাতাবাসী। ক্ষীর, ছানা, গন্দ, বেসন, লাড্ডুর বুঁদির মোদক তো আছেই! মোদকের গর্ভে গরম মশলা থেকে বাটার স্কচ গুঁড়ো ও তরলের পুর। সুগারফ্রি সংস্করণও চালু হয়েছে। আবার ডার্ক বা হোয়াইট চকোলেটের মোদকও স্বমহিমায়। তার গায়ে কেকের আইসিংয়ের প্রলেপে গণেশের শুঁড়-দাঁতের আদল।
গুপ্ত ব্রাদার্সের পরীক্ষিৎ গুপ্ত বা ভিখারাম চাঁদমলের ‘বড়া ভাবী’ চন্দ্রমণি অগ্রবালরা অবশ্য আগেও মোদক গড়তেন। তাঁরা মানছেন, মোদক-প্রীতিতে বাঙালি এখন মাড়োয়ারি, গুজরাতিদেরও টেক্কা দিচ্ছে। আগে ৫০-৬০ কেজির ব্যবসা হলে এ মরসুমে ব্যবসা বেড়ে
প্রায় ১০০০ কেজি ছুঁই-ছুঁই। শহরতলির এক মিষ্টি-কারবারির কথায়, ‘‘আগে জন্মাষ্টমীর পরে খানিকটা অফ-সিজন দেখে বাইরে ঘুরতে-টুরতে যেতাম! এখন রাত জেগে খাটতে হচ্ছে। গণেশ পুজোয় কলকাতা ছাড়ার প্রশ্ন নেই।’’
কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই রয়েছে। সিমলের নকুড়ের দোকানের তরুণ কর্তা পার্থ নন্দী বাজার ধরতে গিয়ে ‘কৌলীন্য খোয়ানো’য় বিশ্বাসী নন। তবে তিনিও বলছেন, গণেশ পুজোর হিড়িকে লাড্ডুর অভাবে তাঁদের দোকানের চকোলেট বলেরও ভালই কদর। মোদকের অভাবে খানিকটা একই আকৃতির সাবেক মনোরঞ্জন সন্দেশও কেউ কেউ চালিয়ে দিচ্ছেন।
জন্মাষ্টমীর মালপো, রথের জিলিপি-পাঁপড়ভাজা বা দোলের মঠ-ফুটকড়াইয়ের মতোই বাঙালির পার্বনী মেনুতে কি তা হলে জায়গা করে নেবে এই নতুন সংযোজন? পাড়ায় পাড়ায় জমকালো গণেশপুজোর আবহে যার যাত্রা শুরু। এত করেও বাঙালি সিদ্ধিদাতার মন পায় কি না, সেটাই এখন দেখার।