অঙ্কন: শৌভিক দেবনাথ
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কলকাতা বন্দর বিধানসভা তৃণমূলের কাছে ‘নিরাপদ’।সে বিধানসভা নির্বাচনই হোক বা পুরভোট।তার কারণ অবশ্যই সংখ্যালঘু ভোট। যে কারণে গত বিধানসভা ভোটে ৬৮,৫৫৪ ভোটে বন্দর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন কলকাতা পুরসভার বিদায়ী মেয়র ফিরহাদ হাকিম।
তাঁর বিধানসভার অন্তর্গত সবক’টি ওয়ার্ডেই ভাল ব্যবধানে জিতেছেন ফিরহাদ। এই পুরভোটেও নিজের কেন্দ্রে তেমনই ফলাফলের প্রত্যাশা করছেন তৃণমূলের ‘ববি-দা’। কলকাতা পুরসভার ৭৫, ৭৬, ৭৮, ৭৯, ৮০, ১৩৩, ১৩৪ এবং ১৩৫— এই আটটি ওয়ার্ড নিয়ে কলকাতা বন্দর বিধানসভা। তবে এর মধ্যে ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডটি ২০১৫ সালের ভোটে দখল করেছিল সিপিএম। বিধানসভা ভোটের ফলাফল অক্ষুন্ন রেখে সেই ওয়ার্ডটি তৃণমূলে নিয়ে আসাই লক্ষ্য থাকবে ওজনদার মন্ত্রী ফিরহাদের।
২০০৯ সালে নতুন করে গঠিত এই বিধানসভা ঐতিহাসিক ভাবে বরাবরই তৃণমূলের গঠনের পর থেকে জোড়াফুলের পাশে থেকেছে। ওয়াটগঞ্জ, খিদিরপুর, একবালপুর, মোমিনপুর ও মেটিয়াবুরুজের একাংশ নিয়ে গঠিত এই বিধানসভায় সংখ্যালঘু ভোটের আধিক্যই তৃণমূলকে সবদিক থেকে নির্ভরতা দিয়েছে।
আবার ঘটনাচক্রে, কবি রঙ্গলাল ভট্টাচার্য, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাইকেল মধূসুদন দত্তের স্মৃতি রয়েছে এই বন্দর বিধানসভাতেই। যা খিদিরপুর ও কবিতীর্থ এলাকাবাসীর কাছে আবেগের। সেই আবেগে প্রতি ভোটে শান দেন রাজনীতির কারবারিরা। কিন্তু ভোট মিটে গেলেই আবার ‘যে কে সেই’পথে চলে কবিদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলি। তবে স্থানীয় বিধায়ককে এলাকায় নিয়মিত দেখতে পান বলেই জানিয়েছেন বেশিরভাগ এলাকাবাসী। মেয়রের বিধানসভা কেন্দ্র হলেও পুর পরিষেবা নিয়ে কিছু অভিযোগ রয়েছে তাঁদের। বিশেষত, কিছু কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে। তবে দল তাঁদের উপরেই ভরসা রেখেছে। তাঁদেরই এই ভোটে আবার প্রার্থী করা হয়েছে বলেই জানিয়েছেন স্থানীয়েরা।
তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে ৭৯ এবং ৮০ নম্বর ওয়ার্ডে ভাল ব্যবধানে এগিয়ে গিয়েছিল বিজেপি। তার কারণ বিশ্লেষণে এলাকার হিন্দিভাষী ভোটারদের কথাই উঠে এসেছিল শাসকদলের নেতাদের কথায়। তবে ২০১৫ সালের পুরভোট থেকে তৃণমূল সেই ব্যবধান মুছে দিতে পেরেছে। জিততে না পারলেও বিজেপি-র ভোটব্যাঙ্ক যে এই বিধানসভায় কিছুটা তৈরি হয়ে গিয়েছে, তার প্রমাণ মিলেছে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাতেও বিজেপি প্রায় ৩৭ হাজার ভোট পেয়ে ২০২১ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে থাকায়।
যে কবিতীর্থ বিধানসভা ভেঙে নতুন বন্দর বিধানসভা তৈরি হয়েছে, সেই কবিতীর্থে কংগ্রেসের ভাল ভোট ছিল। এলাকার ২৫ বছরের বেশি সময় বিধায়ক ছিলেন রাম প্যারে রাম। ৭৯ এবং ৮০ নম্বর ওয়ার্ডও দীর্ঘদিন ছিল রাম প্যারে ও তাঁর স্ত্রীর দখলে। এখন তাঁরা তৃণমূলে। বন্দর বিধানসভায় টিমটিম করে কংগ্রেসের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন ‘বাহুবলী’ কংগ্রেস নেতা মহম্মদ মোক্তার। তবে বিধানসভা ভোটে মাত্র ৫,৫৯০ ভোট পেয়ে জামানত খুঁইয়েছেন তিনি। সেই মোক্তার তাল ঠুকে বলছেন, ‘‘আমি কলকাতা বন্দর ও মেটিয়াবুরুজ বিধানসভা একসঙ্গে পর্যালোচনা করেছি। তাতে দু’একটা ওয়ার্ড আমরা জিততেই পারি।’’
বামেদের শক্তি বলতে বন্দর এলাকার ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড। গত পুর নির্বাচন পর্যন্ত সেখানে সিপিএমই জয়ী হয়েছিল। এ বার ওই আসনে প্রার্থী হয়েছেন সিপিএমের কলকাতা জেলা কমিটির নেতা ফৈয়াজ আহমেদ খান। যিনি ২০০০-’১০ পর্যন্ত ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলেন। ২০০৫-’১০ পর্যন্ত মেয়র পারিষদ ছিলেন। তখন কলকাতার মেয়র ছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য।
২০১০ সালে ওয়ার্ডটি মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায়ফৈয়াজকে সরে দাঁড়াতে হয়। আসনটি সংরক্ষণমুক্ত হতেই ফিরে এসেছেন ফৈয়াজ। তাই গোসা করে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন ১০ বছরের সিপিএম কাউন্সিলর বিলকিস বেগম। তবে ফৈয়াজের কথায়, ‘‘এই দলবদল ভোটে প্রভাব ফেলবে না। কারণ, বিলকিসের বিরুদ্ধে পার্টির কাছে দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়েছিল। আর এই ওয়ার্ডের মানুষ বামেদের ওপরেই আস্থা রাখবেন।’’
ফৈয়াজের প্রতিপক্ষ তৃণমূলের নিজামুদ্দিন শামস আবার সংরক্ষণের কারণেই ৭৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হতে এসেছেন। তিনি বামফ্রন্ট সরকারের খাদ্যমন্ত্রী কলিমুদ্দিন শামসের পুত্র। বন্দর বিধানসভায় এই ওয়ার্ডের লড়াইয়ে নজর থাকবে সকলের। ৭৯ এবং ৮০ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থীদের লড়াই হবে বিজেপি-র সঙ্গে। ৭৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী প্রাক্তন বিধায়ক রাম প্যারে। এলাকার একাংশ বলছেন, তিনি নাকি ‘নিষ্ক্রিয়’।
৮০ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি-র শক্ত ভোটব্যাঙ্কের মুখোমুখি হবেন তৃণমূল প্রার্থী আনোয়ার খান। মহিলা সংরক্ষণের কারণে নিজামুদ্দিন ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হওয়ায় ৭৮নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূলের মহিলা নেত্রী সোমা দাস। ১৩৪ এবং ১৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে ফের প্রার্থী হয়েছেন তৃণমূলের বিদায়ী কাউন্সিলর রঞ্জিত শীল এবং শামস ইকবাল। সংখ্যালঘু ভোটের প্রভাবে তাঁরাও জয় পাবেন বলে ধরে নিচ্ছেন কলকাতার ভোট বিশেষজ্ঞরা।
শুধু ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডেই ভাল লড়াই হতে পারে তৃণমূল বনাম সিপিএমের। সেই লড়াইয়েও তাঁরাই জিতবেন বলে দাবি করছেন ৭৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কো-অর্ডিনেটর তথা তৃতীয়বারের তৃণমূল প্রত্যাশী ষষ্ঠী দাস। তাঁর কথায়, ‘’৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে সাংগঠনিক কিছু সমস্যা ছিল। এ বার সেই সমস্যা মিটে গিয়েছে। তাই আর সিপিএম-কে হারাতে বেগ পেতে হবে না।’’
ফলে মন্ত্রী ফিরহাদের লক্ষ্য একটাই— ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডটিও দখলে এনে আটে-আট করে দলনেত্রীকে উপহার দেওয়া।