সাঁতরেই পার প্রতিবন্ধকতার সাগর

কলেজ স্কোয়ারের বছর ২৪-এর সাঁতারু দীপক নায়েক যখন সেখানকার বিশাল সুইমিং পুল দাপিয়ে সাঁতার কাটেন, তখন তাঁর মধ্যে যেন অনেকেই দেখতে পান আর এক বিখ্যাত প্রতিবন্ধী সাঁতারু মাসুদুর রহমানের ছায়া।

Advertisement

আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৮ ০২:১২
Share:

অদম্য: সুইমিং পুল তোলপাড় করে সাঁতারে মেতেছেন দীপক নায়েক। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

সেরিব্রাল পলসিতে বাঁ হাত পুরোপুরি অকেজো। দু’হাতের আঙুল সোজা করতে পারেন না। কথা বলতে পারেন না। হাঁটাচলাও স্বাভাবিক নয়। কিন্তু জলে নামলে যেন সব প্রতিবন্ধকতাই ম্যাজিকের মতো উবে যায়। তখন তিনি আর পাঁচ জন চ্যাম্পিয়ন সাঁতারুর মতোই সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে, জল তোলপাড় করে সাঁতার কেটে যান।

Advertisement

কলেজ স্কোয়ারের বছর ২৪-এর সাঁতারু দীপক নায়েক যখন সেখানকার বিশাল সুইমিং পুল দাপিয়ে সাঁতার কাটেন, তখন তাঁর মধ্যে যেন অনেকেই দেখতে পান আর এক বিখ্যাত প্রতিবন্ধী সাঁতারু মাসুদুর রহমানের ছায়া। মাসুদুরের দু’টি পা হাঁটুর নীচ থেকে বাদ ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি পার হয়েছিলেন ইংলিশ চ্যানেল। পৃথিবীর প্রথম প্রতিবন্ধী সাঁতারু হিসেবে পার হয়েছিলেন জিব্রালটার প্রণালীও। দীপকের বাবা রজনী নায়েক বলেন, ‘‘মাসুদুরের মতোই হওয়ার স্বপ্ন দেখে দীপক। ও আমাকে হাবভাবে বুঝিয়েছে, ‘মাসুদুর যদি পারে, তা হলে আমি পারব না কেন?’ জাতীয় প্যারাঅলিম্পিক্সে চ্যাম্পিয়নশিপে মেডেল পেয়েছে বেশ কয়েক বার। আন্তর্জাতিক প্যারাঅলিম্পিক্সেও অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে আমার ছেলে।’’

কথা বলতে পারেন না দীপক। কিন্তু সুইমিং পুলে নামলে দীপকের হয়ে কথা বলে তাঁর সাঁতার। কলেজ স্কোয়ারের বাইরের সুইমিং পুল এখনও সাঁতারের জন্য তৈরি হয়নি। কিন্তু অনুশীলনে বিরাম নেই দীপকের। সন্ধ্যায় নেমে পড়েন কলেজ স্কোয়ার সুইমিং ক্লাবের ইনডোর পুলে। দীপকের প্রশিক্ষক সোমনাথ দাস বলেন, ‘‘বাঁ হাতটা একেবারেই অকেজো। এক হাত দিয়েই ও ফ্রি স্টাইল, ব্যাক স্ট্রোক-সহ সব কায়দায় সাঁতার কাটতে পারে। ফ্রি স্টাইলেই ও সব থেকে বেশি মেডেল জিতেছ।’’

Advertisement

কলেজ স্কোয়ার সুইমিং ক্লাবের একটি ঘরে স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে রজনীর টানাটানির সংসার। ওই সুইমিং ক্লাবেরই কেয়ারটেকারের কাজ করেন তিনি। রজনী বলেন, ‘‘জন্ম থেকে সেরিব্রাল পলসিতে ভুগছে ছেলে। সোজা হয়ে দাঁড়াতেও পারত না। কিন্তু ছোট থেকেই ওর সাঁতারের খুব নেশা। অন্যরা যখন সাঁতার কাটত, তখন ও পুলের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত। বলত ও-ও সাঁতার কাটবে। আমরা সাহস করিনি। ওর যখন দশ বছর বয়স, তখন ওকে এক দিন জলে নামিয়ে দেন ওই ক্লাবের এক প্রশিক্ষক দিলীপ মল্লিক। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, কিছু দিনের মধ্যেই ও শিখে গেল সাঁতার!’’

স্বাভাবিক সাঁতারুদের মতোই পরীক্ষা দিয়ে সুইমার হয়েছেন দীপক। ক্লাবের সদস্যদের দাবি, সাঁতারের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর থেকে দীপকের শারীরিক ক্ষমতাও অনেকটা বেড়েছে। ওই ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট দিলীপ মল্লিক বলেন, ‘‘ও যখন সাঁতার শুরু করে, তখন দুলে দুলে কোনও রকমে হাঁটত। সাঁতার ওর মেরুদণ্ড অনেকটা সোজা করেছে। শরীরের জড়তা কেটেছে। সুইমিং ক্লাবের সম্পাদক গৌতম মল্লিক বলেন, ‘‘ও শুধু সুইমারই নয়, ও লাইফ সেভারও। কলেজ স্কোয়ারে যে বাচ্চারা সাঁতার শিখতে আসে, তাদের দিকে কড়া নজর রাখে দীপক। কোনও রকম বিপদের আশঙ্কা দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে উদ্ধারের কাজে।’’

দীপকের থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে কলেজ স্কোয়ারের ওই ক্লাবে প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের জন্য সাঁতারের প্রশিক্ষণ চালু করেছে। সোমনাথবাবু বলেন, ‘‘প্রতি দিন দুপুরে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েরা সাঁতার কাটতে আসেন ইনডোর সুইমিং পুলে। কথা বলতে পারে না দীপক। কিন্তু সাঁতার কেটে ও অন্যদের অনুপ্রেরণা জোগায়। ওর তখন এমন একটা ভাব যে, ‘আমি পারলে তোমরা পারবে না কেন?’ সকলের জন্য উদাহরণ দীপক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন