পত্রিকা বিতরণের জন্য একটা ডাকঘর

বড় রাস্তা পার করে এ পাড়ার কোনাকুনি পার্বতী ঘোষ লেন এবং রমানাথ সাধু লেন জুড়ে থাকা তারিণীচরণ চন্দ্রের বাড়িতেই বোনা হয়েছিল সেই ইতিহাসের বীজ।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৮ ০২:৫০
Share:

সাক্ষী: চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে অর্চনা উপ ডাকঘর। (ইনসেটে) ‘অর্চনা’ পত্রিকার প্রচ্ছদ। নিজস্ব চিত্র

অর্চনা উপ ডাকঘর। ভাবছেন সেটা কোথায়? এ শহরেই। পিন কোড কলকাতা-৭০০০০৭। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির তোরণ বরাবর সোজা তাকালে নজরে পড়বে ডান দিকের এই ডাকঘর! এমন নাম কেন? এ শহরের ইতিহাসের কুলুঙ্গিতে তোলা আছে সেই কাহিনি।

Advertisement

বড় রাস্তা পার করে এ পাড়ার কোনাকুনি পার্বতী ঘোষ লেন এবং রমানাথ সাধু লেন জুড়ে থাকা তারিণীচরণ চন্দ্রের বাড়িতেই বোনা হয়েছিল সেই ইতিহাসের বীজ। তারিণীচরণের ছেলে কৃষ্ণদাস চন্দ্র ছিলেন ব্যবসায়ী। সাহিত্যের নেশায় ১৯০৪ সালে শুরু করেন একটি পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাম দিয়েছিলেন ‘অর্চ্চনা’। প্রথম সম্পাদক ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। গল্প, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, সমালোচনায় ভরা এই মাসিক পত্রিকা আবির্ভাবেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল। সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল পত্রিকার গ্রাহক। এ জন্য ভরসা ছিল ডাক যোগাযোগ। বাদ সাধল সেখানেই। ডাকঘরে তখন কাজের চাপ খুব। অতি ব্যস্ত বড়বাজার ডাকঘর তাই এই মাসিক পত্রিকা বিতরণে হাত তুলে নিল।

শুরু হল অন্য লড়াই। কৃষ্ণদাস একটি উপ ডাকঘরের জন্য আবেদন জানালেন স্টেটসম্যান পত্রিকায় চিঠি দিয়ে। কাজ না হওয়ায় চিঠি লিখলেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জনকে। আবেদন মঞ্জুর হয়। সাব পোস্ট অফিসটি তৈরি হয় ১৯০৬ সালে, ১৮ পার্বতী ঘোষ লেনে। ১৯১৭ সালে ৫১ টাকা ২৫ পয়সায় কৃষ্ণদাসের বন্ধু যুগলকিশোর মুখোপাধ্যায়ের ১০ নম্বর পার্বতী ঘোষ লেনের বাড়ির ঠিকানায় উঠে আসে সাব পোস্ট অফিস। তখন শুধুমাত্র পত্রিকা বিতরণের কাজই হত এখান থেকে। পরের প্রজন্মে ‘অর্চ্চনা’ বানান পাল্টে গিয়ে ‘অর্চনা’ হয়েছে। একটি সাহিত্যপত্রিকা বিতরণের কাজে একটা ডাকঘরের প্রতিষ্ঠা ইতিহাসে বিরল ঘটনা বললে অত্যুক্তি হয় না।

Advertisement

এখনও সেখানেই আছে, বদলেছে শুধু মালিকানা আর ভাড়া। বর্তমানে আটশো টাকা ভাড়ার এই পোস্ট অফিস তিন জন কর্মী নিয়ে সচল। যদিও দীর্ঘ বছর ভাড়ার টাকা নেননি বর্তমান মালিক, জানালেন পোস্টমাস্টার। মালিক ও দফতরের টানাপড়েনে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্ট। বাইরে তখন বৈশাখের ঝাঁ ঝাঁ রোদ, পোস্ট অফিসে পা রাখতেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসে। কালিমাখা দেওয়াল গিলে খায় টিউবের আলো। একটি সদর ভবঘুরের দখলে চলে গিয়েছে অনেক বছর। এমনকি কোথাও কোনও বোর্ড নেই, যাতে লেখা এর নাম মাহাত্ম্য। পুরসভার হেরিটেজ তালিকায় তো দূর অস্ত্‌, তাদের তরফে একটা বোর্ডও দেওয়া হয়নি। সব শুনে বিস্মিত পশ্চিমবঙ্গ সার্কেলের চিফ পোস্ট মাস্টার জেনারেল অরুন্ধতী ঘোষ। তাঁর কথায়, “রাস্তার নাম অনুযায়ী পোস্ট অফিস হয়। এমনটা সত্যিই ব্যতিক্রম। এর ইতিহাস জানা ছিল না| তবে কোনও প্রামাণ্য নথি পেলে আমাদের তরফে একটা ফলক লাগাতে পারি। ভাড়া বাড়িতে থাকা যে কোনও পোস্ট অফিসের ক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণে ন্যূনতম খরচ করে দফতর। এই পোস্ট অফিসের কথাও সে ভাবে বিবেচনা করা হবে।”

সে দিনের সেই পত্রিকা আজ ইতিহাস। শুরু থেকেই তারিণীচরণের বাড়িতেই ছিল পত্রিকার কার্যালয়। বাড়ির এক দিকে বসত ‘অর্চ্চনা পরিষদ’-এর আড্ডা। বিভিন্ন সময়ে সেখানে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গিরিশ ঘোষ, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, আশাপূর্ণা দেবী, মৈত্রেয়ী দেবী, প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র, বিপিনচন্দ্র পাল-সহ বহু ব্যক্তিত্ব। কৃষ্ণদাসের মৃত্যুর পরে তাঁর দুই ছেলে রণজিৎ এবং বাসুদেব পত্রিকার দায়িত্ব নেন। ‘‘সে সময়েই ওই বানান পাল্টানোর

ঘটনা। প্রথমে বাইরে থেকে ছাপা হলেও ১৯৪৮ সালে প্রায় ২২০০ টাকা খরচে যন্ত্র কিনে নিজেদের বাড়িতেই শুরু হয় অর্চনা প্রিন্টিং ওয়ার্কস এবং পাবলিশার্স। তখন পত্রিকার বার্ষিক গ্রাহকমূল্য ছিল ১ টাকা ২৫ পয়সা। টাটা স্টিল, বামার লরি, বসন্ত মালতী, জিসি লাহার বিজ্ঞাপন বুঝিয়ে দেয় পত্রিকার জনপ্রিয়তা। সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার কপিও ছাপা হয়েছে।’’— বলছিলেন কৃষ্ণদাসের নাতি, পেশায় আইনজীবী সৌরভ চন্দ্র। ১৯৬০ সালে পত্রিকা বন্ধ হওয়ার জন্য শেষ সম্পাদক প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র সিনেমার ম্যাগাজিনের দাপটে রুচির বদলকেই দায়ী করেছিলেন।

পত্রিকা নেই সেও হয়ে গেল ৫৮ বছর। কিন্তু পুরনো কলকাতার সরু গলির এক ধারে এখনও মাথা উঁচু করে আছে পত্রিকার নামাঙ্কিত লাল রঙের অর্চনা ভবন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-সহ দু’তিনটি পাঠাগারে রাখা আছে অর্চনার কপি। ব্যস ওই পর্যন্তই। আর কিছু নথি আগলে রেখেছেন সৌরভবাবু। কিন্তু সেটা কত দিন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন