উমা সেস। ফাইল চিত্র
কলকাতা থেকে ফোন করা হয়েছে শুনেই প্রচণ্ড উত্তেজিত তিনি।
মেয়ের প্রসঙ্গ উঠতেই মিনিটখানেক চুপ থেকে তিনি বলেন, ‘‘মেয়েটা যখন মারা গেল, কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এখন আর কিছুতেই কিছু হবে না। মেয়েটা ফিরবে কি?’’
তিনি, অর্থাৎ, আমরি হাসপাতালের মৃতা নার্স উমা সেসের মা খট্টি সেস। গত বছর মেয়ের মৃত্যুর পর থেকে কলকাতার নাম শুনলেই ভয় করে এই মায়ের। এ শহরে এক নার্সিং পড়ুয়ার মৃত্যু হয়েছে শুনে উমার মা বলেন, ‘‘ওখানে কাজ করতে গিয়েই তো...! ওই শহরে কোনও হাসপাতালই কাজ করার জন্য ঠিক নয়।’’
এই শহরের একাধিক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নার্সদের সঙ্গে ‘অসহযোগিতা’ এবং ‘দুর্ব্যবহারের’ অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার রাতেই পিয়ারলেস হাসপাতালের নার্সিং পড়ুয়া রিঙ্কি ঘোষের ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করছে পুলিশ। এ ক্ষেত্রেও হাসপাতালের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করেছেন মৃতা ছাত্রীর সহপাঠীরা। তাঁদের অভিযোগ, ওই নার্সিং পড়ুয়ার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়েছিল। এর জেরেই আত্মঘাতী হয়েছেন রিঙ্কি। আজ, শনিবার বিশ্ব নার্স দিবসের আগে এই নার্সিং পড়ুয়ার মৃত্যুর ঘটনায় অনেকের মনেই ফিরে এসেছে উমার মৃত্যুর ঘটনার স্মৃতি।
গত বছর ১০ অগস্ট আমরি হাসপাতালে মৃত্যু হয় উমার।
তাঁর সহকর্মীদের অভিযোগ ছিল, অসুস্থ হয়ে পড়লেও আমরি হাসপাতালের কর্মী উমাকে ন্যূনতম চিকিৎসা দেওয়া হয়নি সেখানে। উল্টে তাঁকে বলা হয়েছিল, আমরি-তে নয়, নিয়ম মেনে উমার চিকিৎসা করাতে হবে ইএসআই হাসপাতালে। মৃত্যু হয়ে যাওয়ার পরে উমার দেহ আইসিইউ-তে ঢুকিয়ে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সে সময়ে উমার সহকর্মীরা আরও অভিযোগ করেছিলেন, অসুস্থতার জন্য মৃত্যুর আগের রাতে ছুটি চেয়েছিলেন উমা। তবু তাঁকে কাজ করতে বাধ্য করানো হয়েছিল।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃতার বাড়ির লোকজনকে ডেকে টাকার বিনিময়ে বিষয়টি মিটিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছিল এই ঘটনার পরে। আমরি হাসপাতালের সিইও রূপক বড়ুয়া সেই সময়ে জানিয়েছিলেন, মৃতা নার্সের ভাইকে চাকরি দিচ্ছেন তাঁরা। সঙ্গে ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়েছে তাঁর পরিবারকে। সে সবের পরে মরদেহ নিয়ে ওডিশার রৌরকিলার বাড়িতে ফিরে যান মৃতার পরিবারের লোকজন।
শুক্রবার সেখান থেকেই উমার ভাই উমেশ ফোনে বললেন, ‘‘হাসপাতাল যে টাকা দিয়েছিল, তা যথেষ্ট ছিল না। সেই সময়ে এক রকম আমাদের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমরা নিতে না চাইলেও দিদির অ্যাকাউন্টে টাকা ভরে দেওয়া হয়েছিল হাসপাতাল থেকে। আমরা তো বিচার চাইছিলাম।’’ তা হলে পুলিশে অভিযোগ করেননি কেন তাঁরা? উমেশের দাবি, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ আলাদা রাজ্য। সেখানে আমাদের কেউ চেনে না। পুলিশে গিয়ে অত বড় হাসপাতালের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা নেই আমাদের পরিবারের।’’
অবস্থান: নার্সিংয়ের এক ছাত্রীর মৃত্যুর পরে বিক্ষোভে অন্য ছাত্রীরা। শুক্রবার, পিয়ারলেস হাসপাতাল চত্বরে। ছবি:দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
যদিও রূপকবাবু এ দিন বলেন, ‘‘অভ্যন্তরীণ তদন্তে হাসপাতালের গাফিলতির কোনও প্রমাণ মেলেনি। ওই নার্সের নিজেরই কিছু শারীরিক সমস্যা ছিল। তা ছাড়া আমরা ওঁর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলাম।’’
উমেশ জানালেন, দিদির মৃত্যুর ঠিক আগের মাসেই মারা গিয়েছিলেন তাঁদের বাবা। উমেশ নিজে তখন তথ্যপ্রযুক্তির ছাত্র। পরিবারের একমাত্র রোজগেরে দিদিকে বাবার মৃত্যুর এক মাসের মধ্যেই হাসপাতালে কাজে যোগ দিতে হয়েছিল। কলকাতায় চার বছর ছিলেন তিনি। বললেন, ‘‘আমাকে চাকরি করতে বলা হয়েছিল ওই হাসপাতাল থেকে। কিন্তু কলকাতার নাম শুনলেই এখন মা রেগে যান। আমাকে কিছুতেই ওই শহরে কাজ করতে পাঠাবেন না।’’ ফলে আমরি হাসপাতালের দেওয়া চাকরি আর নেননি উমেশ। তবে তাঁদের সংসার চলে কী ভাবে? অন্য চাকরি পেয়েছেন কি উমার ভাই? উমেশ জানান, পড়াশোনা শেষ করে সবে একটি সংস্থায় ইন্টার্নশিপ শুরু করেছেন তিনি। কোনওমতে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে মা-ছেলের সংসার।