শুঁটকি আর পিরের গানে বর্ষবরণ

পথের দু’ধারে তখন তিন্নির মতো বিস্ময় আর মুগ্ধতার অপেক্ষা। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে রবিবার সকাল আটটায় এ শহরের দক্ষিণের মানুষ দেখবেন, পথ দিয়ে চলেছে মন্ত্রী-সান্ত্রী, হাতি-ঘোড়া নিয়ে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:০৮
Share:

সূচনা: তৈরি হচ্ছে খেরোর খাতা।

বাবা, ওটা কী ছুটে আসছে? টাট্টু ঘোড়া, বইয়ে তো দেখেছিস। ফের প্রশ্ন, ওরা কোথায় থাকে? উত্তরের অপেক্ষা না করেই একরত্তি তিন্নির চোখে আর গলায় অপার বিস্ময়, বাবা, এতো বড় মানুষ! ওটা কী ভূত? সিঁধিয়ে যাওয়া ছোট্ট মেয়েটি মুখ লুকোয় বলবান বন্ধুর পিছনে। তাকে সামনে টেনে এনে বাবা হেসে অভয় দেন,— ওরে, একে বলে রণপা। ওঁরা আমাদের মতোই মানুষ। দেখ, দুটো উঁচু লাঠির উপরে কেমন হেঁটে চলেছে। তুই যেমন নাচ শিখিস, তেমন এটাও শিখতে হয়।

Advertisement

পথের দু’ধারে তখন তিন্নির মতো বিস্ময় আর মুগ্ধতার অপেক্ষা। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে রবিবার সকাল আটটায় এ শহরের দক্ষিণের মানুষ দেখবেন, পথ দিয়ে চলেছে মন্ত্রী-সান্ত্রী, হাতি-ঘোড়া নিয়ে এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। কী নেই তাতে? বিক্রমপুরের ঘোড়া, মাটির হাতি, বিশাল আকারের পেঁচা, হারিয়ে যাওয়া টেপা পুতুল, কালীঘাটের পট, বহুরূপী, রকমারি মুখোশে আড়াল হওয়া মানুষ, কীর্তন, পথনাটিকা। বাউল, পিরের মতো লোকগানের সুর আর ঢাক-ঢোল-মৃদঙ্গের তালে তখন পা মেলাবেন মানুষ। শোভাযাত্রার পথে থাকবে রঙিন আলপনা। গাঙ্গুলিবাগান থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার নম্বর ফটক পর্যন্ত চলবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন পরিষদ আয়োজিত এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। সুকান্ত সেতু থেকে আরও একটি শোভাযাত্রা এসে মিশবে সঙ্গে, জানালেন পরিষদের তরফে যাদবপুুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহ উপাচার্য সিদ্ধার্থ দত্ত।

নববর্ষ উপলক্ষে ঢাকায় এমন মঙ্গল শোভাযাত্রা বেরোনোর রেওয়াজ প্রায় তিরিশ বছরের। উৎসবের সেই পরশ এ শহরে ছড়িয়ে দিতে গত বছরের মতো এ বারেও শাহিদুল হক, আমিনুল হাসান লিটুর মতো কয়েক জন ওপার বাংলার শিল্পী পরিষদের পাশে থাকছেন। পরিষদের তরফে বুদ্ধদেব ঘোষ জানান, শনিবার সারারাত চলবে রাস্তায় আলপনা আঁকা।

Advertisement

ওই দিন আরও এক শোভাযাত্রা দেখতে পাবে বর্ষবরণের শহর। সকাল আটটায় জাদুঘর থেকে বেরিয়ে তা শেষ হবে রবীন্দ্র সদনে। কুড়ি ফুট দীর্ঘ কলম বইবে পঞ্চাশ জন শিশু। মুখোশে ঢাকা মুখ, রায়বেঁশে আর মাহালির ছন্দে মাতবে শহর। ২০০৮ সালে কবি শঙ্খ ঘোষ এই বৈশাখী শোভাযাত্রার সূচনা করেন। তার আগে ভাষা ও চেতনা সমিতি আয়োজিত এই উৎসব হত রবীন্দ্র সদন চত্বরে। এ বার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত নাম মাত্র টাকায় মিলবে আমপোড়া শরবত, পান্তাভাত, শিদল, লটে, পুঁটি, চিংড়ির শুঁটকি, ভাত এবং আলু পোস্ত।

পঞ্জিকা কাঁধে যাত্রা। শুক্রবার, কলেজ স্ট্রিটে।

বর্ষবরণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর বৈঠকী আড্ডার শহরে এ এক দমকা হাওয়া। যার সামনে দাঁড়াতে লজ্জা পায় রামনবমীর অস্ত্রমিছিল। তাই শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী রামকৃষ্ণ সাহার মতোই ছাপান্ন ইঞ্চির ছাতি ফুলিয়ে ওই দিনই হালখাতা করবেন গার্ডেনরিচের সামসুল ইসলাম এবং মেটিয়াবুরুজের কাপড় ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন। লাল রঙের খেরোর খাতায় তাঁরাও তুলবেন নতুন হিসাব।

ইতিহাস বলছে, বাংলা বর্ষের গণনা রীতি কিন্তু এক মোঘল সম্রাটের হিসেব মেনেই। মোঘল সম্রাটেরা কৃষকদের থেকে খাজনা নিতেন হিজরি সন অনুযায়ী। অথচ চাঁদের গতিবিধি মেনে চলা হিজরি সন কৃষকদের খাজনা আদায়ের পক্ষে সুসময় ছিল না। সেটা বুঝে, আকবর বদলে দেন খাজনা আদায়ের সময়সূচি। কৃষির সহায়ক সৌর ক্যালেন্ডারের উপরে ভরসা করে হয় নয়া ক্যালেন্ডার হিজরি সৌরপঞ্জি। যার জন্মলগ্ন থেকেই বয়স ৯৬৩ সাল। কারণ হিজরি সন ৯৬৩ সাল অর্থাৎ ইংরেজির ১৫৫৬ সালে সিংহাসনে বসেন আকবর। এই হিসাব ধরেই পরবর্তীকালে হয় বঙ্গাব্দ। চৈত্রের মধ্যে খাজনা মেটানোর সেই শুরু। নতুন বছরে প্রজাদের ডেকে জমিদারদের মিষ্টিমুখ করানোর প্রথার শুরু তখনই।

সেই ট্র্যাডিশনও আজও চলছে। তাই তো আজও এ শহরের অলি-গলি কচি-বুড়োর পায়ের ছন্দে প্রভাত ফেরি দেখে। দোকান থেকে নিমন্ত্রণ পাওয়া খদ্দেররা আজও ভি়ড় করেন। গঙ্গারঘাট জেগে ওঠে স্নান আর লোকাচারে। মন্দিরে মন্দিরে মঙ্গলকামনার ঝুড়ি নিয়ে হাজির হন ভক্ত। হারিয়ে যাওয়া বাঙালি রসনার স্বাদ দিতে হাজির হয় লোভনীয় ছাড়। আর রয়েছে সাদা-লালের ছোঁয়ায় আদি-অকৃত্রিম চৈত্র সেল। এ ডাকে রয়েছে মহুয়ার নেশা। তাতে সাড়া দেননি, এমন বাঙালি থুড়ি শহরবাসী মেলা ভার। নিদেন পক্ষে একটা চাদর, নাইটি অথবা পাজামা নতুন বছরের আগে ঘরে ঢুকবেই।

আজ বছরের শেষ দিন, তিক্ততা ভুলতে নিয়ম মেনে টক আর তেতো উঠবে পাতে পাতে। কারণ আজও এ শহর স্মৃতি ঝেড়ে হাতড়ায় লোকাচার।

ছবি: রণজিৎ নন্দী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন