বর্ষবরণের পুজো চলছে কালীঘাট মন্দিরে। রবিবার। নিজস্ব চিত্র
নববর্ষের সকালে কালীঘাট মন্দিরের ৪ নম্বর গেট অর্থাৎ ‘বাহির পথ’ দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন শুল্ক দফতরের এক পদস্থ অফিসার। সঙ্গে স্ত্রী। কিন্তু কোনও ভাবেই টলানো গেল না কর্তব্যরত পুলিশকর্মীকে। সরাসরি ওই শুল্ক-কর্তাকে তিনি বলে দিলেন, ‘‘স্যর, তিন নম্বর গেট দিয়েই যেতে হবে আপনাকে। ওটাই প্রবেশপথ। দয়া করে আমাকে উপরওয়ালার বকুনি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবেন না।’’ অগত্যা তিন নম্বর গেটের দিকেই স্ত্রীকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন ওই কর্তা।
এ দিনই সকালে লাইন এড়িয়ে পাঁচ যজমানকে নিয়ে ৪ নম্বর গেট দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন এক সেবাইত। পাহারায় থাকা পুলিশকর্মীরাও নাছোড়। সেবাইতের বক্তব্য, ‘‘এক মহিলা যজমান খুব অসুস্থ। এই গেট দিয়ে ঢুকে দর্শন করেই বেরিয়ে আসব।’’ পুলিশকর্মীদেরও বক্তব্য, ‘‘এখানে কেউ থাকতে আসেন না। সকলে দর্শন করতেই আসেন। মূল গেটে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রয়েছেন। তাঁর কাছে গিয়ে অনুমতি নিয়ে আসুন।’’ বেগতিক দেখে পাঁচ যজমানকে নিয়ে সরে প়ড়লেন ওই সেবাইত।
রবিবার সকাল থেকে ছিল অমাবস্যা-যোগ। তার জেরে পুজো অশুভ হতে পারে, এই আশঙ্কায় শনিবার সারা রাত কালীঘাট মন্দিরে চলল হালখাতা পুজো। আর রবিবার বিকেল পর্যন্ত কঠোর পুলিশি নজরদারিতে পুজো দিলেন সাধারণ দর্শনার্থী থেকে শুরু করে আমলা, যজমান এবং নানা পেশার মানুষজন।
শনিবার গভীর রাত থেকেই কালীঘাট মন্দির চত্বর কার্যত চলে গিয়েছিল কলকাতা পুলিশের দখলে। রাত ১২টার পরে পুজো দিতে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় আধ ঘণ্টা মন্দিরে ছিলেন তিনি। পয়লা বৈশাখে মুখ্যমন্ত্রীর পুজো দেওয়া অবশ্য নতুন নয়। মন্দিরের এক পুরোহিতে কথায়, ‘‘দীর্ঘকাল ধরেই বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনে মুখ্যমন্ত্রী এখানে পুজো দেন।’’ পুজো দেওয়ার ফাঁকে মুখ্যমন্ত্রী মন্দিরের সংস্কার নিয়েও কমিটির কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। মন্দির কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগেই কালীঘাট মন্দিরের আমূল সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। উনি সব সময়েই খোঁজ নেন। এ দিনও নিয়েছেন। আমরাও ওঁকে সব জানিয়েছি।’’
নিয়ম অনুযায়ী, সকাল ৬টায় খোলা হয় কালীঘাট মন্দিরের গেট। বন্ধ হয় রাত ১২টায়। কিন্তু এ বছর অমাবস্যা-যোগ থাকায় অনেক দর্শনার্থী মনে করেছিলেন, সকালের পুজো অশুভ। তাই রাতভর মন্দির খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সারা রাত ছিল ভক্তদের দীর্ঘ
লাইন। রাতে মন্দিরের আশপাশের চত্বরে অস্থায়ী ছাউনিতে হয়েছে হালখাতা পুজো।
পুলিশি নজরদারি ছিল কার্যত নজিরবিহীন। মন্দির এলাকার আশপাশের রাস্তায় মোতায়েন ছিলেন ট্র্যাফিক পুলিশ-সহ শতাধিক পুলিশকর্মী। কোথাও মোটরবাইক বা গাড়ি দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। এমনকী, পুলিশের নজর এড়িয়ে যেতে পারেননি মন্দিরের পাণ্ডা বা সেবাইতরাও। সাধারণ ভক্তদের মতো তাঁদেরও নির্দিষ্ট ‘প্রবেশ’ ও ‘বাহির’ পথ ব্যবহার করতে হয়েছে।
লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘এ বছর সাদা পোশাকের পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছিল। তাঁরা মিশে ছিলেন দর্শকদের ভিড়ে। প্রতি বছর মন্দিরের ছ’টি গেট দিয়ে দর্শনার্থীরা যাতায়াত করতেন। এ বার মন্দিরে ঢোকা এবং বেরোনোর জন্য তিনটি করে গেট নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। প্রতি গেটে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে।’’
কালীঘাট থানার এক আধিকারিক জানান, এমন অনুষ্ঠানের দিনে ভিড়ে মিশে থাকে কেপমারেরা। ভিড়ের মধ্যে অনেক দর্শনার্থীর মোবাইল খোয়া যায়। মহিলাদের শ্লীলতাহানির অভিযোগও ওঠে। তার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে নজর রেখেছিলেন সাদা পোশাকের পুলিশকর্মীরা। রবিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মোবাইল চুরি বা কেপমারির ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করছেন পুলিশকর্তারা। কালীঘাট থানার আধিকারিকদেরও দাবি, গত কয়েকটি নববর্ষে নানা অভিযোগ পর্যালোচনা করে এ বছর বেশ কিছু পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেগুলি সফল হয়েছে। রবিবার রাত পর্যন্ত লক্ষাধিক দর্শনার্থী মন্দিরে পুজো দিয়েছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ।