এখনও মায়ের পরিচয়ই যথেষ্ট নয়! বাবার নামটা লাগবেই, নইলে...

‘সিঙ্গল মাদার’ বা একা মায়েরা যেখানে নিজেদের সন্তানদের নিয়ে প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়ছেন। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে পদে পদে যোগ হয়েছে বাস্তব সমস্যাও। স্কুলে ভর্তি থেকে ভিসার আবেদন— সব জায়গাতেই অনিবার্য হয়ে পড়ছে পিতৃ-পরিচয়। আইন বলছে, মায়ের পরিচয়ই সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তা সত্ত্বেও এই টানাপড়েনে ক্রমেই অনিশ্চিত আর ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে শৈশব।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৮ ০২:৫৮
Share:

খাস শহরের বুকেও‘সিঙ্গল মাদার’ বা একা মায়েরা নিজেদের সন্তানদের নিয়ে প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়ছেন।

হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন গৃহকর্ত্রী। নতুন জায়গায় এসেছেন সবে কয়েক দিন হল। নিজে চাকরি করেন। তাই মেয়ের দেখভালের জন্য সারা দিনের এক পরিচারিকাকে ঠিক করেছিলেন। কয়েক দিন কাজে আসার পরেই পরিচারিকা এক সময়ে প্রশ্ন করেন, ‘‘দাদাবাবু নেই?’’ গৃহকর্ত্রী জানিয়েছিলেন, না। ডিভোর্স হয়েছে তাঁর। ছোট মেয়েকে নিয়ে তিনি একাই থাকেন। পরিচারিকার উত্তর ছিল, ‘‘তা হলে আসব না আর!’’ মেয়েকে নিয়ে আতান্তরে পড়েছিলেন ওই মহিলা।

Advertisement

এই কলকাতাতেই এমন ঘটনা ঘটেছে। শুধু ঘটেছে বলা ভুল, ক্রমাগত ঘটেই চলেছে। ‘সিঙ্গল মাদার’ বা একা মায়েরা যেখানে নিজেদের সন্তানদের নিয়ে প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়ছেন। সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে পদে পদে যোগ হয়েছে বাস্তব সমস্যাও। স্কুলে ভর্তি থেকে ভিসার আবেদন— সব জায়গাতেই অনিবার্য হয়ে পড়ছে পিতৃ-পরিচয়। আইন বলছে, মায়ের পরিচয়ই সন্তানের জন্য যথেষ্ট। তা সত্ত্বেও এই টানাপড়েনে ক্রমেই অনিশ্চিত আর ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে শৈশব।

রাজ্যের শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের তথ্য বলছে, একা মা হওয়ার কারণে শিশুদের স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয়নি, এমন অভিযোগের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। আর সে সব স্কুল কোনও প্রত্যন্ত গ্রামের নয়, খাস শহরের। যাঁদের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়েছে বা বিচ্ছেদের মামলা চলছে, শুধু তাঁদের ক্ষেত্রেই নয়। যাঁরা বিয়ে না করেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে (আইভিএফ) মা হয়েছেন, তাঁদেরও একই অভিজ্ঞতা!

Advertisement

স্কুলে শিশুকে ভর্তি নেওয়ার আগে অভিভাবকদের যে সাক্ষাৎকার-পর্ব হয়, সেখানে বাচ্চার মাকে এমনও জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, কেন তিনি একা থাকেন বা কেন তিনি এ ভাবে মা হয়েছেন? কখনও আবার শিশুর পিতৃ-পরিচয় কী, তা আরটিআই করে স্কুলে জানতে চাওয়া হয়েছে! যার সঙ্গে একটি শিশুর শিক্ষার অধিকারের কোনও রকম যোগসূত্রই নেই! অথচ, দিনের শেষে পিতৃ-পরিচয়ই প্রধান হয়ে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন সরকারি আধিকারিকেরা।

বাবা কে? এই প্রশ্নে প্রতিনিয়ত বিব্রত হতে হচ্ছে মায়েদের। কমিশনের চেয়ারপার্সন বলেন, ‘‘মায়ের পরিচয়ই বাচ্চার জন্য যথেষ্ট। আইনত এটা সিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত জায়গাতেই একা মায়েদের অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হয়।’’

আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হয়েছেন চলচ্চিত্রকার অনিন্দিতা সর্বাধিকারী। অনিন্দিতা এখনও তাঁর ছেলেকে স্কুলে ভর্তির লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কারণ, অনলাইনে ফর্ম পূরণের সময়ে বাবার নাম ও ছবি দেওয়াটা বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেটা না দেওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই ফর্ম বাতিল হয়ে যাচ্ছে। যেখানে নিজে গিয়ে ফর্ম তোলার সুযোগ রয়েছে, সেখানে ফর্ম তো পূরণ হল। কিন্তু তার পরে রয়েছে সাক্ষাৎকার-পর্ব। যে পর্বে শিশুর ভবিষ্যতের থেকেও বেশি প্রাধান্য পেয়েছে বা পাচ্ছে একা মায়ের প্রসঙ্গটি। এমনকি, শিশুর যে কোনও বাবা নেই এবং সে আইভিএফ পদ্ধতিতে জন্মেছে, এমন কথাও হলফনামা দিয়ে তাঁকে জমা দিতে বলা হয়েছে বলে জানাচ্ছেন অনিন্দিতা! তাঁর কথায়, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট যেখানে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, মায়ের পরিচয়ই শিশুর জন্য যথেষ্ট, সেখানে প্রতিনিয়ত আমাকে লড়ে যেতে হচ্ছে। এটাই আমার জীবনের সব থেকে বড় লড়াই।’’

চিত্রশিল্পী ইলিনা বণিকেরও একই অভিজ্ঞতা। তিনিও আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হয়েছেন। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। তার উপরে দক্ষিণ কলকাতার যে অভিজাত পাড়ায় তিনি থাকেন, সেখানেই সন্তানের পিতৃ-পরিচয় নিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ইলিনার কথায়, ‘‘সন্তানবাসনা বরাবরই ছিল। তাই ডিভোর্সের পরেও আইভিএফ পদ্ধতিতে মা হয়েছিলাম। কিন্তু তার পরেই বুঝতে পারি, সিঙ্গল মম নিয়ে যত বৈপ্লবিক আলোচনাই হোক, একা মা হওয়াটা এখনও যেন ভীষণ অপরাধের!’’ যদিও আইন স্পষ্ট করেই বলছে, শিশুর স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে মায়ের পরিচয়ই যথেষ্ট।

কলকাতার প্রাক্তন মেয়র তথা আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আইনে এ ব্যাপারে স্পষ্ট বলা রয়েছে। যদি কোনও স্কুল বা কোনও প্রতিষ্ঠান পিতৃ-পরিচয় নেই বলে ভর্তি নিতে অস্বীকার করে, তা হলে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’’

সমাজতত্ত্ববিদদের একাংশ বলছেন, আসলে আইনে অনেক কিছুই পাশ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি। কারণ, সামাজিক বিন্যাসের সঙ্গে আইনসিদ্ধ বিষয়টির সামঞ্জস্য তৈরি হয়নি। একা মায়ের বিষয়টিও তেমন। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডু বলেন, ‘‘সামাজিক জীবনের সঙ্গে পিতৃ-পরিচয় এখনও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাই স্কুলে ভর্তি হোক বা পাসপোর্টের আবেদন, একা মায়েরা প্রতিনিয়তই সমস্যায় পড়েন। যতই আইন করা হোক, সমাজ অতটা এগোতে পারেনি বোধহয়।’’

কিন্তু অনিন্দিতার মতো একা মায়েরা আস্তে আস্তে জোটবদ্ধ হচ্ছেন। অনিন্দিতা জানাচ্ছেন, শহরে একা মায়েদের একটা ক্লাব তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। যেখানে তাঁরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে যোগাযোগ করতে পারবেন। লড়তে পারবেন একসঙ্গে। আর সেই লড়াইয়েই শক্ত হবে ‘মাতৃভূমি’র ভিত! বলছেন একা মায়েরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন