ভরসা: ‘চেম্বারে’ গীতাদেবী। নিজস্ব চিত্র
সিস্টার গীতাদির চেম্বার!
কলকাতায় এমন চেম্বারের অবস্থান জানতে চাইলে অনেকেই অবাক হবেন। কারণ ঝাঁ চকচকে কোনও বাড়িতে নয়, ওই চেম্বার চলে খোলা আকাশের নীচে। ফুটপাতের উপরে টেবিল-চেয়ার পেতে এপ্রন পরে স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে বসেন গীতাদি। রক্তচাপ, ব্লাড সুগার পরীক্ষা থেকে বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে কী করণীয়, সহজেই যেমন জানা যায়, তেমনই তৎক্ষণাৎ কারও কোনও ওষুধের প্রয়োজন হলে তাও বেরিয়ে আসে গীতাদির ঝুলি থেকে।
প্রায় ১৩ বছর ধরে রাসবিহারী, হাজরা বা সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের মোড়ের চেম্বারে বসে ট্র্যাফিক পুলিশ, পথচারী, ফুটপাতবাসীদের চিকিৎসা করছেন ষাটোর্ধ্ব গীতা দে। রাজা বসন্ত রায় রোডের ওই বাসিন্দা দক্ষিণ কলকাতার এক নামী বেসরকারি হাসপাতালের নার্স ছিলেন। ২০০৩ সালে স্বেচ্ছাবসর নিলেও জারি রেখেছেন নিজের সেবাকাজ। যার ফলেই তিনি এখন ‘সিস্টার গীতাদি’ হয়ে উঠেছেন কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশকর্তা থেকে কর্মীদের কাছে।
ক্যানসারে আক্রান্ত বাবা কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যে স্ট্রোকে মা-ও পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। গীতাদেবী বলেন, ‘‘এত বাধার মধ্যেও আদর্শ সেবিকা হওয়ার ইচ্ছা তাড়া করত।’’ এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে নার্সিংয়ের প্রশিক্ষণ শেষ করে সরকারি, বেসরকারি স্তরে কিছু দিন কাজ করার পরে ১৯৮৬-তে পাকাপাকি ভাবে ওই হাসপাতালে যোগ দেন তিনি। সেখান থেকে চাকরি ছাড়ার কয়েক মাস পরে এক দিন তিনি দেখেন, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে কর্তব্যরত এক ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীর হাত দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরছে। প্রচণ্ড রোদে দাঁড়িয়ে ওই পুলিশকর্মী রুমাল দিয়ে তা আটকানোর চেষ্টা করছেন। এই ঘটনা দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেননি গীতাদেবী।
এর পরেই এক দিন গন্ধরাজ লেবু, নুন, চিনি মিশিয়ে শরবত বানিয়ে অনেকগুলি বোতলে ভরে নিয়ে স্বামী সনৎ দে-র স্কুটারে চেপে বেরিয়ে পড়েছিলেন গীতাদেবী। ঘুরে বেড়াতেন সারা শহরে। এপ্রন পরা এক মহিলাকে পানীয়ের বোতল এগিয়ে দিতে দেখে অনেক পুলিশই প্রথমে অবাক হয়েছিলেন। ওই সেবিকা বলেন, ‘‘গরমে ওই শরবত কেন খাওয়া দরকার, বোঝাতে সকলেই উৎসাহী হলেন। তবে আর স্কুটারে যাই না।’’ এখন কলকাতা পুলিশের অ্যাম্বুল্যান্সে করেই শরবত বিলি করতে যান গীতাদেবী। আবার শীতের রাতে বেরিয়ে পড়েন কফি, চা, বিস্কুট নিয়ে।
২০০৩ সালে এক ট্র্যাফিক পুলিশকর্মীকে জ্বরে কাঁপতে দেখে চেম্বার খোলার সিদ্ধান্ত নেন গীতাদেবী। সেই শুরু। স্বামীর স্কুটারে বসে এখনও সেখানে পৌঁছে যান এপ্রন পরা সেবিকা। কয়েক ঘণ্টার চিকিৎসার শেষে তাঁকে নিজেদের গাড়িতেই বাড়ি পৌঁছে দেন পুলিশ অফিসারেরা। গীতাদেবীর চেম্বারে ট্র্যাফিক পুলিশেরা যেমন কাজের ফাঁকে রক্তচাপ বা সুগার মেপে নেন, তেমনই পথচারী থেকে ফুটপাতবাসীরাও পান সেবা। আগে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা সমর বিশ্বাস নামে এক যুবকের বাঁ পায়ের ক্ষততে পোকা হয়েছিল। তাঁকে নিজের খরচে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করেছেন গীতাদেবী। সমর বলেন, ‘‘দিদি না থাকলে পা-টা হয়তো থাকতই না।’’
গীতাদেবী জানান, কলকাতার ২৫টি ট্র্যাফিক গার্ড, লালবাজারের মূল গেটের পাশের পুলিশ বুথ-সহ ন’টি অ্যাম্বুল্যান্সে রয়েছে তাঁর দেওয়া ‘মেডিক্যাল কিট’। যাতে প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম ছাড়াও থাকে প্যারাসিটামল, বুকে ব্যথার ওষুধের মতো অনেক কিছু। কখন কোন ওষুধ ব্যবহার করতে হবে, তাও শিখিয়ে দেন তিনি। মাঝেমধ্যে ফোন করে জেনে নিয়ে শেষ হওয়া ওষুধ ভরে দিয়ে আসেন বাক্সে। ২০১১-তে কলকাতা পুলিশের শীর্ষ কর্তা সৌমেন মিত্রের নির্দেশে ট্র্যাফিক পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে গীতাদেবী শেখাতেন, কী ভাবে নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে। শুধু তা-ই নয়, গভীর রাতে কোনও ওষুধ জানতে বা শারীরিক সমস্যা হলে পরামর্শ নিতে সিস্টারকেই ফোন করেন ট্র্যাফিক পুলিশের অনেকে। দুর্গাপুজো কিংবা বর্ষবরণের রাতেও থাকে বিশেষ দায়িত্ব। গীতাদি বলেন, ‘‘আমি তো ২৪ ঘণ্টাই অন কল’’।