ক্লাসে বসে সহবত শেখার পাঠ নিলেন অটোচালকেরা

মুম্বইয়ের অটোচালক জয়কুমার পেরুমলের কাহিনি জয় করে নিল কলকাতার শ’খানেক অটোচালকের মন। মুম্বইবাসী জয়কুমার পেরুমল কয়েক বছর আগে খবরের শিরোনামে এসেছিলেন। কষ্ট করে অটো চালিয়ে মেয়ে প্রেমাকে পড়াশোনা শেখান। সেই মেয়েই এক দিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়ে বাবার মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। সারা দেশের খবরের কাগজে গর্বিত পিতা হিসেবে জয়কুমারের ছবি বেরিয়েছিল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৪ ০২:১২
Share:

মুম্বইয়ের অটোচালক জয়কুমার পেরুমলের কাহিনি জয় করে নিল কলকাতার শ’খানেক অটোচালকের মন।

Advertisement

মুম্বইবাসী জয়কুমার পেরুমল কয়েক বছর আগে খবরের শিরোনামে এসেছিলেন। কষ্ট করে অটো চালিয়ে মেয়ে প্রেমাকে পড়াশোনা শেখান। সেই মেয়েই এক দিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেয়ে বাবার মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন। সারা দেশের খবরের কাগজে গর্বিত পিতা হিসেবে জয়কুমারের ছবি বেরিয়েছিল।

এ ভাবেই শুরু করলেন মোটিভেশন-স্পিকার ইন্দ্রজ্যোতি সেনগুপ্ত। তিনি বললেন, “আপনাদের উপরে দায়িত্ব অনেক বেশি। আপনারা যে পরিষেবা দিচ্ছেন, তাতে গর্ব হওয়া উচিত। নিজেদের ছোট মনে করে ভাল মানুষ হয়ে উঠুন। হয়ে উঠুন পেরুমলের মতো। যাত্রীদের সঙ্গে ভাল ব্যহার করুন, আবার বাড়ি গিয়ে পরিবারকেও দেখুন। দেখবেন, নিজেকে আনন্দে রাখতে পারবেন”

Advertisement

রবিবার কলকাতা পুলিশের উদ্যোগে বালিগঞ্জ শিক্ষা সদনে হয়ে গেল অটোচালকদের কর্মশালা। মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করলেন দক্ষিণ-পূর্ব ট্রাফিক গার্ডের অন্তর্গত বিভিন্ন রুটের ১১০ জন অটোচালক। ছিলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার সতীজীবন নাথ, ট্রাফিক ট্রেনিং স্কুলের ওসি জীবন মুখোপাধ্যায়-সহ ওই ট্রাফিক গার্ডের সার্জেন্ট অলক সান্যাল। কর্মশালার প্রথম ধাপ শুরু হল অটোচালকদের মানসিক ভাবে উদ্বুদ্ধ করে।

জয়কুমারের পাশাপাশি ইন্দ্রজিতবাবু কর্মশালায় অংশ নেওয়া এক অটোচালককে দেখিয়ে উদ্ধুদ্ধ করলেন বাকিদের। অটোচালক সুব্রত দেবনাথ। বছর উনিশের ওই কিশোর দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ কলেজে রসায়ন নিয়ে প্রথম বর্ষে পড়ছেন। পাশাপাশি, পরিবারকে সাহায্য করতে অটো চালান। সুব্রতর বক্তব্য, “আমি চেষ্টা করি যাত্রীদের সঙ্গে গোলমাল না করতে। কারণ আমাদের মতো ওঁদেরও নানা সমস্যা থাকে।”

অটোচালকদের মানসিক ভাবে চাঙ্গা করার পাশাপাশি ট্রাফিক ট্রেনিং স্কুলের এক অফিসার তুলে ধরেন বিভিন্ন দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ। সম্প্রতি শহরের বিভিন্ন রাস্তায় দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গিয়েছেন, কেন মারা গেলেন তাঁরা, ছবি দেখিয়ে তা বোঝানো হয় অটোচালকদের। কী ভাবে তাঁরা দুর্ঘটনা এড়িয়ে নিরাপদে যাত্রীদের পৌঁছে দেবেন বা নিজেরা বাড়ি যাবেন, তা-ও বলা হয়। দেখা যায়, ছবিতে দুর্ঘটনা-চিত্র দেখে অটোচালকেরা শিউরে উঠছেন এবং মন্তব্য করছেন, এ ভাবে গাড়ি চালানো ঠিক নয়। ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলার অঙ্গীকারও করেন তাঁরা।

এ দিনের কর্মশালায় বারবার ঘুরেফিরে এসেছে গত কয়েক মাসে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে অটোচালকদের সঙ্গে যাত্রীদের গোলমালের প্রসঙ্গ। সম্প্রতি তারাতলায় খুচরো দিতে না পারায় এক মহিলাকে চড় মারেন এক অটোচালক। পার্ক সার্কাসে বেশি ভাড়া না দেওয়ায় এক মহিলার মাথায় রড দিয়ে মারেন আর এক অটোচালক। গাঙ্গুলিবাগানে আবার অটোর ধাক্কায় প্রাণ হারান এক প্রৌঢ়। ওই সব ঘটনার কথা উল্লেখ করে ইন্দ্রজ্যোতিবাবু বলেন, “যাত্রীরা আপনাদের লক্ষ্মী। তাঁদের এমন অবস্থা কেন করবেন আপনারা? ওঁদের ছাড়া আপনাদের অস্তিত্ব যেমন নেই, তেমনি আপনারা ছাড়াও যাত্রীদের চলবে না। যাত্রীরা খারাপ ব্যবহার করলেও, আপনারা ভাল ব্যবহার করুন।”

কর্মশালায় অটোচালকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নেও নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। শুধু নিজেরা ভাল ব্যবহার করাই নয়, সহকর্মীদেরও ভাল ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে বললেন ইন্দ্রজ্যোতিবাবু। কয়েক জন অটোচালকের খারাপ ব্যবহারের জন্য সব অটোচালকের বদনাম হচ্ছে বলেও বলেন তিনি। তাঁর পরামর্শ, “যাত্রীদের সম্মান করুন। দেখুন তাঁরাও আপনাকে সম্মান করবেন।”

মনস্তাত্ত্বিকের মাধ্যমে বিভিন্ন পেশার মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করে তোলার ঘটনা নতুন নয়। অনেক বড় বড় ব্যক্তিকে সাফল্যের শিখরে পোঁছে দিতে নেপথ্যে অনেক সময়েই নানা মনস্তাত্ত্বিক টোটকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। একই ভাবে বেপরোয়া অটোচালকদের শোধরাতেও মনস্তাত্ত্বিক দাওয়াই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে বলেই মনে করছেন কলকাতার পুলিশকর্তারা। এ দিনের ওই কর্মশালায় উপস্থিত দক্ষিণ-পূর্ব ট্রাফিক গার্ডের ওসি অলক সান্যাল বলেন, “এই ধরনের কর্মশালায় অটোচালকদের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব কমিয়ে আনা যায়। পুলিশের উপরে ওঁরা ভরসা খুঁজে পান। ওঁদের বোঝানো হয় যে ওঁরাও মানুষ। ভুল হতেই পারে। কিন্তু ঠিক মতো চললে এবং ভাল ব্যবহার করলে, ওঁনারাও ভাল ব্যবহারই ফেরত পাবেন।”

কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগে সত্যিই কি অটোচালকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে? দক্ষিণ ২৪ পরগনার আইএনটিটিইউসি-র সভাপতি মেঘনাথ পোদ্দার বলেন, “নতুন সরকার এসে এমন উদ্যোগ নিয়েছে। দু’-এক জন অটোচালক যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করছেন। এই ধরনের কর্মশালায় তাঁদের অনেকটাই শোধরানো যাচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন