হাইড রোডের সেই জমির পাঁচিল। —ফাইল চিত্র।
সুসম্পর্কের বার্তা নিয়ে সদ্য নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দরবারে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মমতা প্রশাসনের বিরুদ্ধেই ‘অসহযোগিতা’র অভিযোগ তুলে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করল কেন্দ্রীয় সংস্থা কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ (কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট, সংক্ষেপে কেপিটি)। বিবাদী পক্ষ হিসেবে খোদ রাজ্যের স্বরাষ্ট্র-সচিব ও কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে রেখে দায়ের হওয়া মামলাটির মূলে রয়েছে বন্দরের তারাতলার জমি, যা কিনা মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী শ্রীকান্ত মোহতা দীর্ঘ দিন কব্জা করে রেখেছেন বলে অভিযোগ।
বন্দরের দাবি: তারাতলার হাইড রোডে তাদের মালিকানাধীন একশো কাঠা জমিতে (বর্তমান বাজারদর কম করে ৫০ কোটি টাকা) গত তিন বছর ধরে পাঁচটি স্টুডিও চালাচ্ছে শ্রীকান্তের সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। তার লিজ-ভাড়া বাবদ বছরে অন্তত ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা বন্দরের কোষাগারে আসার কথা। অথচ ভেঙ্কটেশ এক পয়সাও ঠেকায় না। কোর্টের নির্দেশ নিয়ে জমি ‘উদ্ধার’ করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ে বন্দর-কর্তাদের ফিরতে হয়েছিল। পরে ওঁরা পুলিশের দ্বারস্থ হন। লাভ হয়নি। ‘‘পুলিশের সঙ্গে বারবার আলোচনা করেও ফোর্স মেলেনি।’’— আক্ষেপ করেছেন কেপিটি’র চেয়ারম্যান রাজপালসিংহ কাহালোঁ।
এমতাবস্থায় হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ চাওয়া ছাড়া উপায় থাকছে না বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান। বস্তুত কলকাতা পুলিশ-কর্তৃপক্ষ যে ভাবে বিষয়টিকে বারবার ‘পাশ কাটিয়েছেন’, তা দেখে কেপিটি রীতিমতো হতাশ। কী রকম?
বন্দর-সূত্রের খবর: চেয়ারম্যান কাহালোঁ নিজে কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে চিঠি লিখে বেআইনি দখলদারির কথা জানিয়েছিলেন। চিঠিতে তাঁর আবেদন ছিল, আইন-শৃঙ্খলায় বিঘ্ন না-ঘটিয়ে বন্দর যাতে নিজের জমির অধিকার ফিরে পেতে পারে, পুলিশ তাতে সাহায্য করুক। এক কর্তার দাবি, স্থানীয় পুলিশকে অন্তত আধ ডজন চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারাতলা থানার সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তিন-তিন বার উচ্ছেদের চূড়ান্ত দিনক্ষণ স্থির করেও শেষে নানা অজুহাত দেখিয়ে পিছিয়ে আসে বলে ওঁদের অভিযোগ। ‘‘শেষ বার ঠিক হয়েছিল, গত ৮ অগস্ট অভিযান হবে। এ বারও পরে পুলিশ জানিয়ে দেয়, স্বাধীনতা দিবসের পর্ব না-মিটলে ফোর্স পাঠানো যাবে না।’’— বলেন ওই কর্তা। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘মনে হচ্ছে, হাই প্রোফাইল ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে যেতে পুলিশের পা সরছে না।’’
সেই কারণেই হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের জমি তো চাইলে সিআইএসএফের সাহায্যেও উদ্ধার করা যেতে পারে?
বন্দর-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: সেটা করাই যায়। তবে আইন-শৃঙ্খলা যে হেতু রাজ্য সরকারের বিষয়, তাই প্রাথমিক ভাবে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে কাজ উদ্ধারের চেষ্টা হচ্ছে। ‘‘হাইকোর্ট বললে আমরা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সিআইএসএফ নিয়ে জমি দখল করে নেব,’’ মন্তব্য বন্দরের এক আধিকারিকের।
এ বিষয়ে রাজ্য সরকারের বক্তব্য কী?
স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও মন্তব্য করতে চাননি। পুলিশ কমিশনারকে ফোনে পাওয়া যায়নি, তিনি এ সংক্রান্ত এসএমএসের উত্তরও দেননি। স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা অবশ্য বলেছেন, ‘‘মামলা যখন হয়েছে, তখন কোর্টেই যা হওয়ার হবে।’’ আর শ্রীকান্ত মোহতার প্রতিক্রিয়া, ‘‘এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনও খবর নেই।’’
জমি নিয়ে জট পাকল কী ভাবে?
বন্দর-সূত্রের খবর: পি-৫১, হাইড রোডের প্রায় ১৮৫ কাঠা জমি ১৯৬৯-এ দেওয়া হয়েছিল ওজনযন্ত্র নির্মাতা অ্যাভারি ইন্ডিয়াকে, তিরিশ বছরের লিজে। ১৯৯৯-এ লিজের মেয়াদ ফুরোলে জমির দখল নিতে গিয়ে কেপিটি দেখে, অন্য কিছু সংস্থা ওখানে স্থায়ী কাঠামো বানিয়ে ফেলেছে! তাদের উচ্ছেদ করতে ২০০০ সালে ‘দ্য পাবলিক প্রেমিসেস (এভিকশন অব আনঅথরাইজড অকুপ্যান্টস)-১৯৭১’ আইনে বন্দরের এস্টেট অফিসারের এজলাসে মামলা দাখিল করে কেপিটি। অ্যাভারির হয়ে শুনানিতে এসে এলএমজে কনস্ট্রাকশন নামে এক সংস্থা যুক্তি দেয়, অ্যাভারির তরফে তারাই জমিটির রক্ষণাবেক্ষণ করছে, অতএব বন্দর তাদের নামেই লিজ নবীকরণ করে দিক।
মামলা গড়ায় পাক্কা এগারো বছর। ২০১১-র ৭ মার্চ কেপিটি’র এস্টেট অফিসার নির্দেশ দেন, সমস্ত জবরদখলকারীকে সরিয়ে বন্দরই জমির দখল নেবে। তাতে অবশ্য কাজ হয়নি। ২০১২-র মাঝামাঝি নাগাদ খবর মেলে, সেখানে নতুন করে অবৈধ নির্মাণ চলছে। অফিসারেরা গিয়ে দেখেন, শেড বানিয়ে স্টুডিও তৈরি হচ্ছে। ১৮৫ কাঠার মধ্যে প্রায় ১০০ কাঠা কব্জা করে নিয়েছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস!
কেপিটি’র এক কর্তা জানিয়েছেন, এর পরে কয়েক বার চেষ্টা করা হলেও মূলত পুলিশি অসহযোগিতার দরুণ তাঁরা জমি হাতে পাননি।
২০১৩-য় কেপিটি ফের এস্টেট অফিসারের এজলাসে মামলা করে। ওই বছরের ২৬ অগস্ট এস্টেট অফিসার রায় দেন, জমি উদ্ধারের জন্য পুলিশি মদত জরুরি। তাই পুলিশকে কাজটা করতে হবে।
তবু অবস্থা যে-কে-সে-ই! পুলিশ কেন এমন নিস্পৃহ?
লালবাজারের অফিসারেরা কেউ ‘সরকারি’ভাবে মুখ খুলতে চাননি। যদিও একান্ত আলোচনায় অনেকে স্বীকার করেছেন, এ ক্ষেত্রে শ্রীকান্ত মোহতার ‘প্রভাবের’ কথা বিলক্ষণ মাথায় রাখা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের অন্যতম মুখটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করে নবান্নের শীর্ষ মহলের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি কেউ নিতে চাইছেন না। ওঁর হাত যে কত লম্বা, সাম্প্রতিক অতীতে তার একাধিক দৃষ্টান্ত মিলেছে। যেমন, কর ফাঁকির অভিযোগে শ্রীকান্তের অফিসে তল্লাশি চালাতে গিয়ে নবান্নের ফোনে হাত গুটোতে হয়েছিল বাণিজ্য-কর অফিসারদের। আবার শ্রীকান্তের আর্থিক স্বার্থ দেখতে গিয়ে কলকাতা পুরসভা বিপুল রাজস্ব-ক্ষতি স্বীকার করেও লেক মলের লিজ-চুক্তি দু’ভাগে ভাঙার প্রস্তাব করেছে বলে অভিযোগ। উপরন্তু লেক মল বন্ধক রেখে তিনি যাতে ব্যাঙ্ক-ঋণ পান, সে বন্দোবস্তও পাকা। এবং এমন নানা বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেও মুখ্যমন্ত্রীর দেশ-বিদেশের নিত্য সফরসঙ্গী শ্রীকান্ত মোহতা। ‘‘ওঁর বিরুদ্ধে যাওয়ার বুকের পাটা কার আছে?’’— পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছেন লালবাজারের এক অফিসার।
অগত্যা হাইকোর্টই ভরসা বন্দরের।