নাচ-গান-নাটকে স্বপ্ন বুনছে ‘কোমলগান্ধার’

সোনাগাছির সার দেওয়া ঘরগুলোতে তখন উঁকি দিচ্ছে পড়ন্ত বেলার রোদ। চোখে-ঠোঁটে রঙ ঘষে একটু একটু করে এ বার তৈরি হওয়ার পালা। সন্ধে হতে না হতেই যে ভিড় জমাবেন ‘বাবু’রা। জংধরা বারান্দায় হেলান দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গুনগুন করছিলেন সুলেখা রায়। পাশের জানলায় চোখে কাজল দিতে দিতে সেই গান শুনছিলেন অতসী পাল। গান শেষ হতেই বললেন, ‘‘বাঃ! তোর গলাটা তো বেশ ভাল।’’

Advertisement

মধুরিমা দত্ত

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৫ ০০:৪৩
Share:

চলছে কোমলগান্ধারের মহড়া। বৃহস্পতিবার, সোনাগাছিতে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

সোনাগাছির সার দেওয়া ঘরগুলোতে তখন উঁকি দিচ্ছে পড়ন্ত বেলার রোদ। চোখে-ঠোঁটে রঙ ঘষে একটু একটু করে এ বার তৈরি হওয়ার পালা। সন্ধে হতে না হতেই যে ভিড় জমাবেন ‘বাবু’রা। জংধরা বারান্দায় হেলান দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গুনগুন করছিলেন সুলেখা রায়। পাশের জানলায় চোখে কাজল দিতে দিতে সেই গান শুনছিলেন অতসী পাল। গান শেষ হতেই বললেন, ‘‘বাঃ! তোর গলাটা তো বেশ ভাল।’’ লজ্জা পেয়ে হাসলেন সুলেখা। কিন্তু মনে মনে সেই ‘বেশ ভাল’টা যেন বলছিল, এখানেই শেষ নয়।
গুনগুনিয়ে ওঠা সেই সুরটাকে সম্বল করেই তৈরি হয়ে গেল ‘কোমলগান্ধার’। নিত্যদিনের যন্ত্রণার বিনিময়ে এক টুকরো আকাশের মতো। সেই কোমলগান্ধার-ই যে এক দিন তাঁদের বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে, গান-নাচ-নাটকের মহড়ায় পাল্টে দেবে সোনাগাছির বিকেলগুলো— তা অবশ্য সেদিন বুঝতে পারেননি যৌনকর্মীরা।
কী এই কোমলগান্ধার?
সদস্য সুলেখা রায় জানান, মাত্র কয়েক জন যৌনকর্মীর উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে অনুমোদিত সংগঠন রূপে আত্মপ্রকাশ করে কোমলগান্ধার। বছর দুয়েকের মধ্যেই বিরাট এক সুযোগ। জেনিভাতে বিশ্ব এড্‌স দিবসের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ডাক পেয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই দর্শকের মন জয় করে নেয় তারা। অনেকখানি বেড়ে যায় মনোবল।
সুলেখা বলেন, ‘‘সেই প্রথম বার মনে হয়েছিল, আমরাও পারি। আমরাও ফেলনা নই।’’ আর পিছনে তাকাতে হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও কখনও দিল্লি থেকে তামিলনাড়ু, কখনও বা ব্যাঙ্কক থেকে সিঙ্গাপুর, সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে কোমলগান্ধারের সুর।
শুরুর দিনগুলোর লড়াইটা অবশ্য সহজ ছিল না। সংগঠনের সদস্য তাঞ্জিনা খাতুন জানান, প্রথম প্রথম শুধু যৌনকর্মীরা এলেও ক্রমশ মায়েদের হাত ধরে আসতে শুরু করে তাঁদের সন্তানেরাও। কিন্তু তালিম নিতে গিয়ে বারবারই অপমানের মুখে পড়তে হয়েছে তাদের। তাঞ্জিনা বলেন, ‘‘প্রথমে কেউ শেখাতে চায়নি আমাদের। বলেছে, ‘‘তোমরা এলে কোনও ভদ্র ঘরের বাচ্চা আর শিখতে আসবে না। তোমাদের শেখাতে গিয়ে আমাদের ব্যবসা লাটে তুলব নাকি?’ অনেকে তো ঘাড়ধাক্কাও দিয়েছে।’’
সংগঠনে মূকাভিনয়ের তালিম দেন শিল্পী রণেন চক্রবর্তী। তিনি জানালেন, প্রথম দিকে অনেকের মধ্যেই ওঁদের নিয়ে মজা করার প্রবণতা ছিল। কিন্তু ১৯৯৯ সালে রাজ্য সরকার আয়োজিত নাট্যমেলায় ‘ভালো মানুষ নই গো মোরা’ নামে একটি নাটক করে কোমল গান্ধার। সেই সময়ে মহড়ায় নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন বিশিষ্ট নাট্যশিল্পীরা। এই নাটকটি চমকে দেয় সকলকেই। রণেনবাবু বলেন, ‘‘আসলে সবাই যেটাকে এঁদের দুর্বলতা ভাবে, আসলে সেটাই এঁদের শক্তি।’’

Advertisement

বাইরে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে সমস্যা হয়নি কখনও?

কোমলগান্ধারের রূপান্তরকামী সদস্য ববি পাল জানালেন, অনেক সময়েই লোকে অভব্য আচরণ করে। বলে ‘হিজড়া নাচ’ দেখাতে। ববি বলেন, ‘‘আগে খুব কষ্ট হতো। মাঝে মাঝে মনেও হয়েছে, কী হবে এ সব করে? সমাজের চোখে আমরা চিরকাল একঘরেই থাকবো।’’ তবে শত মন খারাপেও লড়াইটা জারি রেখেছিলেন কোমলগান্ধারের সৈনিকরা। রোজ একটু একটু করে নিজেদের তৈরি করেছেন। তালিম নিতে শুরু করেছেন বিভিন্ন শিল্পীর কাছে।

Advertisement

এখন অবশ্য অনেকটাই পাল্টেছে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। এমনটাই দাবি এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়ের। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আন্দোলনের অন্যতম অস্ত্র এখন কোমলগান্ধার। শুধু তা-ই নয়, আগামী দিনে জীবিকার দিশাও দেখাবে এই দলটি।’’

একই মত ওই সংগঠনের মুখ্য উপদেষ্টা স্মরজিৎ জানারও। তিনি জানান, পারফর্মিং আর্টস বা নানা শিল্প মাধ্যমে মানুষের অন্তরের কথাগুলো বেরিয়ে আসে সহজে। সমাজের কাছে নিজেদের তুলে ধরতে সুবিধা হয়। স্মরজিৎ বলেন, ‘‘সমস্ত যৌনপল্লিরই একটা নিজস্ব সংস্কৃতি থাকে। এখানে ওরা সেটাকেই কাজে লাগিয়েছে।’’

আর তাতেই আসছে একের পর অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ। ‘ডেট’ দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন কোমলগান্ধারের শিল্পীরা। খুব শিগগিরই ঢাকা পাড়ি দেওয়ার কথা জানালেন সংগঠনের সম্পাদক প্রিয়া ঘোষ। এ বার দুর্গাপুজোতেই তাঁদের বায়না রয়েছে এ শহরের নানা পুজো কমিটির অনুষ্ঠানে। যেতে হবে দুর্গাপুরেও।

অল্প বয়সে বিয়ে করে ফেলেছিলেন মণীষা। স্বামীর ঘরে জুটেছে রোজকার মারধর। তবু নাচ ছেড়ে থাকতে পারেননি। তিন বছরের সন্তানকে নিয়ে নিয়মিত মহড়ায় আসেন মনীষা। ছোট থেকেই গান গাইত মিতা। বদলে বাবার থেকে জুটত মার। আর এখন? নিয়মিত রাগসঙ্গীতের তালিম নিচ্ছে সে।

যৌনকর্মীর সন্তান হয়ে প্রেম করার খেসারত দিতে হয়েছে প্রিয়াকে। প্রেমিকের বাড়ির লোক চড়াও হয়েছে তাঁর উপর। তবু প্রিয়ার দৃপ্ত ঘোষণা, ‘‘বিয়ে যদি করি, কাগজে লেখা থাকবে কোমলগান্ধার ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, তাতে ছেলের সই থাকবে। তবেই বিয়ে হবে।’’

বহু যৌনকর্মীকে বেঁচে থাকার নতুন আশা জুগিয়ে তাই কোমলগান্ধার এখন সোনাগাছির বড় আদরের ধন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন