সচেতনতাই নেই, পর্ষদ তাই অনাগ্রহী সীসাহীন রঙে

অবশেষে ঘুম ভাঙল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের। গত দশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার মৃৎশিল্পীদের হাতে পরিবেশবান্ধব রং তুলে দেওয়ার কথা আর ভাবছে না পর্ষদ।

Advertisement

মেহবুব কাদের চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:২০
Share:

অবশেষে ঘুম ভাঙল দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের। গত দশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার মৃৎশিল্পীদের হাতে পরিবেশবান্ধব রং তুলে দেওয়ার কথা আর ভাবছে না পর্ষদ। মৃৎশিল্পীদের সচেতন করতে তাঁদের হাতে ওই রং তুলে দিয়ে কাজের কাজ যে কিছু হচ্ছে না তা এক কথায় স্বীকার করে নিলেন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র। কল্যাণবাবুর পর্যবেক্ষণ, ‘‘সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কয়েক বছরে পরিবেশবান্ধব সীসামুক্ত রং শিল্পীদের দেওয়ার পরেও কেউ তা প্রতিমার কাজে ব্যবহার করছেন না। তাই এ বছর এখনও ওই রং বিলির সিদ্ধান্ত হয়নি।’’ এ বার সীসামুক্ত রং ব্যবহারের জন্য বিকল্প প্রচারের ব্যবস্থা করার কথা ভাবতে হবে বলেও জানান কল্যাণবাবু।

Advertisement

প্রতিমাশিল্পীরা যাতে সীসামুক্ত রং ব্যবহার করেন, সে জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রচার শুরু হয়েছে ২০০৬ থেকে। ফি বছর পুজোর মাসখানেক আগে কর্মশালা করে শিল্পীদের হাতে ওই রং তুলে দেয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। বাস্তবে দেখা গিয়েছে, সীসামুক্ত রঙের বদলে সাধারণ রঙেই প্রতিমায় প্রলেপ দেন শিল্পীরা। কুমোরটুলি থেকে কালীঘাটের পটুয়াপাড়া— ছবিটা সর্বত্র একই।

কুমোরটুলিতে গিয়ে দেখা গেল, শিল্পীরা সাধারণ রং ব্যবহার করছেন। গত বছরের সীসামুক্ত রং কারও স্টুডিওয় অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে, কেউ সিংহাসন বা কাঠামোয় ব্যবহার করছেন। ওই রঙের কথা শুনেই বিরক্তি প্রকাশ করলেন শিল্পী বাবু পাল। তাঁর কথায়, ‘‘সীসামুক্ত রং ব্যবহারে কেবল শিল্পীদের বললেই হবে না। পুজো উদ্যোক্তাদেরও সচেতন করতে হবে। পুজোর ক’দিন আগে সরকারি তরফে যে পরিমাণে পরিবেশবান্ধব রং বিতরণ করা হয় তাতে কাজের কাজ হয় না। তাই শিল্পীরা তা ব্যবহার করেন না।’’ পুজোর আর ২০ দিন বাকি। অন্য বছর মাসখানেক আগে কুমোরটুলির শিল্পীদের হাতে পরিবেশবান্ধব রং তুলে দেওয়া হলেও এ বছর এখনও তা দেওয়া হয়নি। কবে দেওয়া হবে জানেন না শিল্পীরা।

Advertisement

কুমোরটুলিতে এখন শিল্পীর সংখ্যা প্রায় ৬০০। রয়েছে তাঁদের তিনটি সংগঠন। এর মধ্যে কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সাংস্কৃতিক সমিতির অধীনে রয়েছেন প্রায় ৩০০ জন। এ ছাড়া কুমোরটুলি প্রগতিশীল মৃৎশিল্প ও সাজশিল্প সমিতি ও কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সমিতির অধীনে রয়েছেন প্রায় ১৫০ জন করে শিল্পী। কুমোরটুলি মৃৎশিল্প সাংস্কৃতিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক রঞ্জিত সরকার বলেন, ‘‘পরিবেশবান্ধব রং ব্যবহারের জন্য বছরভর সচেতনতামূলক প্রচার চালাতে হবে। পুজোর মাসখানেক আগে শিল্পী পিছু ১-২লিটার রং দেওয়া গিমিক ছাড়া কিছু নয়।’’ রঞ্জিতবাবুর কথায়, ‘‘সরকারি তরফে যে রং ব্যবহারের কথা বলা হয় তাতে প্রতিমায় ঔজ্জ্বল্য আসে না। তাই শিল্পীরা তা ব্যবহার করেন না। আমাদের সংগঠনের শিল্পীরা তাই গত দু’বছর ওই রং নিতে যাননি।’’

কুমোরটুলি প্রগতিশীল মৃৎশিল্প ও সাজশিল্প সমিতির সম্পাদক অপূর্ব পালের কথায়, ‘‘সরকারি তরফে নমুনা হিসাবে শিল্পী পিছু মাত্র ২ লিটার করে সীসামুক্ত রং দেওয়া হয়। এতে কাজ হয় না। বাড়তি রং কেনা ব্যয়সাপেক্ষ। সীসামুক্ত রঙের দাম সাধারণ রঙের পাঁচগুণ।’’ শিল্পী সনাতন দিন্দাও বলেন, ‘‘সীসামুক্ত রঙের দাম বেশি হওয়ায় মৃৎশিল্পীরা তা গ্রহণ করছেন না। তা ছাড়া এর প্রয়োগও শক্ত।’’

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এবং ইন্ডিয়ান টক্সিকোলজি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের যৌথ সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতিমা নির্মাণে ব্যবহৃত রঙে প্রতি গ্রামে ৬-১০ মাইক্রোগ্রাম সীসা থাকে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে খবর, বহু ভারী ধাতু (পারদ, ক্যাডমিয়াম, জিঙ্ক অক্সাইড, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি) থাকলেও বেশি ক্ষতি করে সীসা। বিসর্জনের পরে যা জলে মিশে বাস্তুতন্ত্র নষ্ট করে। গঙ্গা দূষণ রোধে তাই পরিবেশবান্ধব রং ব্যবহার চালু করতে উদ্যোগী হয় পর্ষদ।

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় পরিবেশ দফতর ২০১২-এ শিল্প কাজ ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে রঙে ক্যাডমিয়াম, সীসা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু তা-ও অবৈধ সীসাযুক্ত রং প্রতিমা নির্মাণে কাজে লাগানো হচ্ছে। ওই রং জলে গেলে মাছের শরীরে ঢুকে মানব দেহেও প্রভাব ফেলে।’’ বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, ‘‘শিল্পীদের সীসামুক্ত রং ব্যবহারে সরকারি তরফে সার্বিক সচেতনতা অভিযান চালানো জরুরি।’’ পরিবেশবিদ সুভাষ দত্তের বক্তব্য, ‘‘মাসখানেক আগে শিল্পীদের হাতে রং তুলে দেওয়াটা সচেতনতামূলক কর্মসূচি হতে পারে না। সরকারকে পুজো উদ্যোক্তাদেরও কঠোর ভাবে সচেতন করতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন