পুরভোটের দিন গিরিশ পার্কে এসআই জগন্নাথ মণ্ডলকে গুলি করার ঘটনায় ধৃতেরা যে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ, রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে পাঠানো পুলিশ কমিশনারের রিপোর্টে তার উল্লেখই নেই! বৃহস্পতিবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় বলেন, ‘‘লালবাজার থেকে যে রিপোর্ট আমাদের কাছে এসেছে, তাতে ধৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় বলা নেই।’’
লালবাজার সূত্রে বলা হচ্ছে, ওই রিপোর্টে ধৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় না থাকলেও তাদের নাম রয়েছে। যে দু’টি রাজনৈতিক দল (পড়ুন কংগ্রেস ও তৃণমূল) সে দিন গোলমালে জড়িয়েছিল, তাদের নামও উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। কিন্ত তদন্ত পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত ধৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় নিশ্চিত করে বলা যাবে না, এই যুক্তি দেখিয়ে কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তার দাবি, ‘‘এই কারণেই ধৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় দেওয়া হয়নি।’’ একই সঙ্গে লালবাজারের শীর্ষ কর্তারা একে পুলিশ কমিশনারের রিপোর্ট বলতেও অস্বীকার করেছেন। তাঁদের ব্যাখ্যা, থানা স্তর থেকে তৈরি হওয়া ওই রিপোর্ট ধাপে ধাপে পুলিশের সদর দফতরে এসেছে। সেটাই নির্বাচন কমিশনকে পাঠানো হয়েছে। যদিও কমিশন সূত্রের বক্তব্য, কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থর সই করা ওই রিপোর্ট তাঁর বলেই গণ্য করা হবে।
প্রকাশ্য রাস্তায় পুলিশ অফিসারকে গুলি করায় অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় বড়কর্তারা দিলেন না কেন, সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে লালবাজারের অন্দরেই। পুলিশের একাংশের অভিযোগ, শাসক দলকে আড়াল করতেই এমন রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশেরই এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘আমাদের উপরে শাসক দলের প্রভাব থাকে, এটা বাস্তব ঘটনা। তা বলে গুলি খেলেও বলতে পারব না!’’
রিপোর্টে কী লিখেছেন সিপি?
পুলিশ কমিশনারের রিপোর্ট পড়ার পর সুশান্তবাবু জানান, গত শনিবার ভোট মিটে যাওয়ার পরে গিরিশ পার্কে একটি কংগ্রেস অফিসে হামলা হয়। সেখানে পুলিশ যায়। তখন সেখানে তৃণমূলও এসে হাজির হয়। ওই হামলা মিটতে না মিটতেই অদূরে সিংহিবাগানে ঝামেলা শুরু হয়। তখন পুলিশ সেখানে গিয়ে দেখে লাঠি, রড নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়েছে। সে সময়ই গুলি চলে। তাতেই আহত হন এসআই জগন্নাথ মণ্ডল।
পুলিশের অনেকেই বলছেন, গিরিশ পার্কের ঘটনার পর রাজ্য নির্বাচন কমিশন লালবাজারের রিপোর্ট তলব করেছিল। কমিশন সূত্রের খবর, বুধবার রাতে লালবাজারের রিপোর্ট পৌঁছয় তাদের দফতরে। বৃহস্পতিবার তা হাতে পান রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। ঘটনাচক্রে, পুরভোটে সন্ত্রাস নিয়ে বুধবারই নির্বাচন কমিশনারকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। তার পরেই পুলিশের রিপোর্ট পাঠানোয় জল্পনা শুরু হয়েছে প্রশাসনের অন্দরে।
কমিশন সূত্রের খবর, গিরিশ পার্কের ঘটনার কথা পুলিশ তাদের জানায়নি। তারা সংবাদমাধ্যম থেকে ঘটনার কথা জানতে পেরে লালবাজারের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ভোটের দিন এমন ঘটনা ঘটলেও তা কমিশনকে জানানো হল না কেন? কলকাতা পুলিশের একাধিক কর্তার দাবি, শনিবার, পুরভোটের দিন প্রতি দু’ঘণ্টা অন্তর কমিশনে খবর পাঠাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু জগন্নাথ মণ্ডল গুলিবিদ্ধ হন ভোটপর্ব মিটে যাওয়ার পরে। তাই সেই খবর কমিশনে জানানো হয়নি।
যদিও প্রাক্তন পুলিশকর্তাদের অনেকেই এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, ভোটের দিন যে কোনও ঘটনা নির্বাচন কমিশনকে জানানো উচিত। তাদের জানার অধিকারও রয়েছে। তা ছাড়া, জগন্নাথবাবু ভোটের ডিউটিতে ছিলেন। সে দিন ঘটনার সময় ভোটদান পর্ব মিটলেও ভোট পুরোপুরি শেষ হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে এক জন কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা কমিশনকে অবশ্যই জানানো উচিত ছিল। কলকাতা পুলিশের এক প্রাক্তন কমিশনারের বক্তব্য, ‘‘পুরো ঘটনা জানিয়ে রিপোর্ট তো পাঠানোই যেত। কেন করা হল না, সেটাই বুঝতে পারছি না।’’
কমিশনকে রিপোর্ট দিতে এত দেরি হল কেন? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্র দেরির অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, ‘‘২০ এপ্রিল রিপোর্ট চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। তাতে দু’দিন সময় দেওয়া ছিল। সেই সময়সীমা মেনেই ২২ তারিখের মধ্যে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে।’’
পুলিশকর্তারা যা-ই বলুন না কেন, গিরিশ পার্কের ঘটনা নিয়ে সরগরম লালবাজার। নিচু ও মাঝারিতলার অফিসারেরা বলছেন, গিরিশ পার্কের ঘটনায় শাসক দলের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় পুলিশের শীর্ষ কর্তারা চুপ করে রয়েছেন। বস্তুত, জগন্নাথবাবু গুলিবিদ্ধ হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই লালবাজারের গুন্ডাদমন শাখায় খবর আসে, মধ্য কলকাতার দুষ্কৃতী গোপাল তিওয়ারি ও তার দলবল এই ঘটনায় জড়িত। পুলিশের একাংশের বক্তব্য, শাসক দল ঘনিষ্ঠ গোপালকে ধরতে লালবাজারের কর্তারা ভরসা পাচ্ছিলেন না।
লালবাজার সূত্রের খবর, পুলিশকর্তাদের এই ইতস্তত মনোভাবের খবর পৌঁছে গিয়েছিল গোপালের কানেও। তাই ঘটনার পর দু’দিন সে নির্বিঘ্নেই বাড়িতে ছিল। কিন্তু পরে হাওয়া গরম দেখে কলকাতা ছাড়ে। তার দলের বাকি সদস্যরাও পলাতক বলে পুলিশের দাবি। লালবাজারের একাংশ বলছেন, গোপালের সঙ্গে শাসক দলের অনেক নেতার ঘনিষ্ঠতার কথাই সামনে চলে আসছে। ওই নেতাদের নির্দেশেই গোপাল ভোটে তার বাহিনীকে নামিয়েছিল। গোপালকে ধরলে শাসক দলের অনেকের নাম উঠে আসবে। সেই বিড়ম্বনা ঠেকাতেই তাকে নাগালের বাইরে রাখতে চাইছেন লালবাজার ও শাসক দলের একাংশ।
গিরিশ পার্কের তদন্ত এবং গোপালকে ধরা নিয়ে বড়কর্তাদের মেজাজ দেখে হতাশ লালবাজারের নিচু তলা। তাঁরা বলছেন, ‘‘পুলিশকে গুলি করেও যদি পার পাওয়া যায়, তা হলে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দেবে কে?’’ আঙুল উঠছে পুলিশের কিছু কর্তার দিকেও। লালবাজার সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাতে গোপালকে ধরতে ফাঁদ পাতা হয়েছিল। কিন্তু সে খবরও তার কাছে আগাম পৌঁছে গিয়েছিল! কলকাতা পুলিশের বড় কর্তারা প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ শুধু বলেছেন, ‘‘গোপাল ও তার শাগরেদদের খোঁজ চলছে। তাদের গ্রেফতারও করা হবে।’’