প্রতীকী চিত্র
অত্যাচারী জমিদারদের আমলে বা সুদখোর মহাজনদের কারসাজিতে গরিব চাষি ঘুম ভেঙে দেখতেন, রাতারাতি তাঁর জমি অন্যের নামে চলে গিয়েছে। জমিদার-জমানা শেষ হলেও সেই দখলদারি চলছে আজও। গ্রামবাসীরা দেখছেন, তাঁদের অজান্তে সরকারি নথিতে তাঁদের জমি হাতবদল হয়ে গিয়েছে কোনও না কোনও সংস্থার নামে! এবং এমনটা ঘটছে কলকাতার অদূরেই।
রাজারহাটের পাথরঘাটা পঞ্চায়েতের অন্তর্গত চকপাচুড়িয়া মৌজার এই ধরনের ঘটনার তিনটি লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরে। প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, জমি-মাফিয়াদের একটি চক্র এর সঙ্গে জড়িত।
দক্ষিণ চকপাচুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা অরুণ মণ্ডলের পরিবারের ২১৪০ এবং ২১৪১ দাগে প্রায় এক বিঘা জমি রয়েছে। অরুণবাবু জানান, মাস দুয়েক আগে তাঁর খুড়তুতো ভাই দীপু মণ্ডল মোবাইলে তথ্য যাচাই করে জানান, সরকারি নথিতে সংশ্লিষ্ট দু’টি দাগের জমি আর অরুণবাবুদের নামে নেই। তাঁরা নাকি সেটি ১১টি কোম্পানিকে বিক্রি করে দিয়েছেন! অরুণবাবুর কথায়, ‘‘কাউকে জমি বিক্রি করিনি। কী ভাবে এটা হল, তা জানতে রাজারহাটে ভূমি ও ভূমি রাজস্ব কার্যালয়ে যাই। অর্ডার শিট তুলে দেখি, কয়েকটি সংস্থা ওই জমির মালিক হয়ে গিয়েছে!’’
রাজারহাট ভূমি ও ভূমি রাজস্ব কার্যালয় সূত্রের খবর, অরুণবাবুর অভিযোগ পেয়ে অফিসারেরা দেখেন, ১০১৮৭ নম্বরের যে-দলিলের ভিত্তিতে অরুণবাবুদের জমির মালিকানা বদল হয়েছে, সেটি আসলে বাগুইআটির রঘুনাথপুরের একটি জমির দলিল! ওই দলিলকে কাজে লাগিয়েই চকপাচুড়িয়ায় জমির মালিকানা বদলে ফেলা হয়েছে! ওই অফিসের এক কর্তা বলেন, ‘‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ওই দলিল জাল বলেই মনে হচ্ছে।’’
অরুণবাবুদের মতো সম্প্রতি একই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন নীলকান্ত মণ্ডল। ন’টি খতিয়ানে থাকা তাঁর এক বিঘা ১৩ কাঠা জমি বেহাত হয়ে যায়। নীলকান্তবাবু বলেন, ‘‘গত জুনে আচমকা কোম্পানির লোকজন জমি দখল করতে আসে। জমির শরিকদের অধিকাংশই সই করতে পারেন না। আমার ছেলে প্রতিবন্ধী। অথচ সকলের নামের পাশে ইংরেজি ও বাংলায় সই রয়েছে। দলিলে আমার যে-ছবি, দিয়েছিল সেটিও জাল। নবান্নের হস্তক্ষেপে জমি ফেরত পেয়েছি।’’ ধাড়সা-মোক্তারপুর মৌজাতেও এই ধরনের অভিযোগ পেয়েছে রাজারহাটের ব্লক কার্যালয়।
ওই কার্যালয়ের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘দলিলে সরকারি সিলমোহর, বয়ান এমন ভাবে লেখা হচ্ছে যে, দেখে বোঝার উপায় নেই, সেটি জাল! আমাদের সন্দেহ, পুরো ঘটনার সঙ্গে একটি চক্র জড়িয়ে আছে। নীলকান্তবাবুর ঘটনায় নিউ টাউন থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।’’ দলিল জাল হচ্ছে কী ভাবে? গ্রামবাসীরা জানান, দলিলের প্রথম ও শেষ পাতার সইকে কাজে লাগিয়ে মাঝখানের বক্তব্য পুরো বদলে ফেলা হচ্ছে। এই ভাবেই চলছে জালিয়াতি।
গ্রামবাসীরা এত দিন ধরে প্রতারণার শিকার হওয়া সত্ত্বেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন? নীলকান্তবাবুর অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাঁর ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ করা হয়েছে?
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক জানান, লিখিত অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দফতরের তরফে তদন্তে নেমে অভিযুক্ত সংস্থাগুলির ঠিকানায় লোক পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেই সব ঠিকানায় অধিকাংশ কোম্পানির কোনও অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। ‘‘ব্লক কার্যালয়ের কেউ জড়িত আছে কি না, তারও তদন্ত দরকার। এরা এতই বেপরোয়া যে, নীলকান্তবাবুর জমি ফিরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পাল্টা চিঠি দিয়েছে,’’ বলেন ওই আধিকারিক।
রাজারহাট পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ মহম্মদ আফতাব উদ্দিন বলেন, ‘‘জমির দালাল চক্র যে-ভাবে সক্রিয়, তাতে গ্রামবাসীরা আতঙ্কিত,’’ ডিসি (সদর) অমিত জাভালগি জানান, অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত চলছে। কারা এই ধরনের দুষ্কর্ম করছে, তা খতিয়ে দেখার পরেই বিস্তারিত ভাবে কিছু বলা সম্ভব।