বুধবার কলকাতায় ডোরিনা ক্রসিংয়ে বক্তৃতা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
মমতা বলেন, “বাংলা আমাদের দখলে আছে, থাকবে। আগামী দিনে সকলকে সাথে নিয়ে দিল্লি দখলও আমরা করব।” ২০২৬ সালের বাংলার বিধানসভা ভোটের পরে লোকসভা নির্বাচনে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ই সফল হবে বলে জানান তিনি।
বিজেপির উদ্দেশে মমতা বলেন, “আগামী দিন ভয়ঙ্কর। তোমরা নিজেরা থাকবে কি না ক্ষমতায়, আগে সেটা বিচার করো। তার পরে বাঙালিক মারো।” তিনি আরও বলেন, “অসম সরকার ১২ লক্ষ মানুষকে বিতাড়ণ করেছে। কারণ, তারা অসমিয়া ভাষা জানেন না।” ওড়িশা সরকারকেও নিশানা করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, “ সতর্কবার্তা দিয়ে গেলাম। মারবও না, কাটবও না, আপনাদের মতো ভাষা বিকৃতও করব না। যে ভাষায় আপনারা কথা বলেন, সেই ভাষায় আমরা কথা বলি না। তাই পরিষ্কার বলি, যদি না থামেন, তবে আগামী দিনে আপনাদের থামতে কী করা দরকার, সেটা বুঝে নেবেন।” কোথাও বাঙালিদের উপর অত্যাচার হলে বাংলার পাশাপাশি সেখানে গিয়েও প্রতিবাদ হবে, সে কথাও জানিয়ে দেন মমতা। তিনি বলেন, “আমরা আহত হয়েছি। আমরা আহত হলেও সুসংহত। এর জবাব আমরা দেবই দেব।”
বাংলার যে পরিযায়ী শ্রমিকেরা ভিন্রাজ্যে কাজ করেন, তাঁদের ফিরে আসার অনুরোধ করেন মমতা। তৃণমূলনেত্রী বলেন, “আপনারা ফিরে আসুন। যদি আমার কাছে একটা রুটি থাকে, আপনাকে অর্ধেক দিয়ে দেব। ওখানে অসম্মানে থাকবেন না। এখানে আপনাদের জন্য সব আছে। বাইরে বিজেপিকে বিশ্বাস করবেন না। এরা ভয়ঙ্কর, এখন তো আরও ভয়ঙ্কর। আমাদের কাছে যা তালিকা আছে, প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি লোককে গ্রেফতার করে লকআপে নিয়ে গিয়েছে, ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশে কত জনকে পাঠিয়ে দিয়েছে, সেই তথ্যও আমরা সংগ্রহ করছি।”
মমতা বলেন, “আমি বাংলায় কাজ করি। বাংলার লোকে আমাকে বেছে নিয়েছেন। আমাকে বাংলায় কাজ করতে দিন। বাংলায় আমার সমস্যা করলে আমি গোটা ভারতে ঘুরব। আমাকে আপনারা আটকে রাখতে পারবেন না। আমি দেখব কতগুলি ডিটেনশন ক্যাম্পে আমাকে নিয়ে যেতে পারেন। সেখানে গিয়েও আমি বাংলাতেই কথা বলব। বাংলার লোকেদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখলে বাংলার মানুষও বিজেপিকে নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক ভাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখবে।”
ভোটার তালিকার কাজ শুরু হলে প্রত্যেকের নাম ভোটার তালিকায় রয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য বলেন মমতা। তাঁর অভিযোগ, অন্য রাজ্যে বসে সেখানকার সংস্থাকে দিয়ে এ রাজ্যের ভোটারদের নাম কাটা হচ্ছে।
ডোরিনা ক্রসিংয়ের মঞ্চ থেকে সিপিএমকেও বিঁধলেন মমতা। বললেন, “শূন্য হয়ে গিয়ে মহাশূন্যে গিয়েছে। তা-ও লজ্জা নেই। রাম-বাম জোট বেঁধেছে। এই সব অত্যাচার করে ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দিয়ে স্বপ্ন দেখছে, আবার কেশপুর, গড়বেতা, ছোট আঙারিয়ায় হত্যা করবে। আবার কৃষক-শ্রমিকদের উপর গুলি চালাবে। আবার আনন্দমার্গীদের পুড়িয়ে মারবে। বিজেপির সাথে হাত মিলিয়ে জগাই-মাধাই-গদাই— এদের চিহ্নিত করুন।”
মমতা বলেন, “তোমরা কে যে ঠিক করে দেবে কে কোথায় থাকবে, কে কী খাবে, কী পরবে, কে কোন ভাষায় কথা বলবে! লজ্জা নেই তো। আমার টুইট করে বলছে, আমি নাকি মিথ্যা কথা বলেছি। জিজ্ঞেস করুন তো অনেক জায়গায় বোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে অলরেডি। প্রত্যেকে তাঁর নিজের শরীর বোঝে। কে শিঙাড়া খাবে, কে সমোসা খাবে, তোমার কী! কে জিলিপি খাবে, কে পোহা খাবে, ধোসা খাবে না ইডলি খাবে, না কি ঠেকুয়া খাবে, না কেউ ছানার রসগোল্লা খাবে, হালুয়া খাবে… সেটা তাদের ঠিক করতে দাও।”
মমতা বলেন, “আমি বাংলায় বেশি করে কথা বলব। ক্ষমতা থাকলে আমাকে ডিটেনশন ক্যাম্পে আগে রাখো।” ধর্ম দেখে দেখে মানুষকে বাছা হচ্ছে বলে অভিযোগ মমতার। বিজেপিকে বিঁধে তিনি বলেন, “বিজেপি জেনে রাখো, খেলা হবে। তৈরি থাকো।” নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে ভোটার বাদ দেওয়ানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ মমতার।
মমতার অভিযোগ, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যাকেই সন্দেহ হবে জেলে নিয়ে এক মাস রেখে দিতে পারো। বিনা বিচারে এক মাস রেখে দেবেন? এটা কী! এ তো জরুরি অবস্থার থেকেও বেশি। ইন্দিরা গান্ধীকে গালাগাল দিয়ে সুপার ইমার্জেন্সি ডে পালন করলেন। তা হলে আপনারা কী করছেন! এ তো জরুরি অবস্থার থেকেও বেশি কিছু। অবৈধ ভাবে আইন করেছে, যে আইনের মানে বোঝে না।”
মমতা বলেন, “যত স্বাধীনতা সংগ্রামী রয়েছেন, তাঁদের নামের মধ্যে ৭০ শতাংশ বাংলার লোক আছেন। যাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন পঞ্জাবিরা। যাঁরা দেশ স্বাধীন করেছেন, যাঁরা জাতীয় সঙ্গীত দিয়েছেন, যাঁরা জনগণমন অধিনায়ক গেয়েছেন, যাঁরা জয় হিন্দ স্লোগান দিয়েছেন, আজ তাঁদের উপর অত্যাচার? আজ এনআরসির নামে তাঁদের বাদ দেওয়া হচ্ছে?”
মমতা জানান, ছত্তীসগঢ়ের খবর পেয়ে নদিয়ার বাংলাভাষীদের ছাড়াতে মহুয়া মৈত্র সেখানে গিয়েছেন। দিল্লিতেও হেনস্থার শিকার বাঙালিদের নিয়ে ৪৮ ঘণ্টা ধর্না করেছেন। তিনি বলেন, “কোচবিহারের বাসিন্দাদের অসম সরকার নোটিস পাঠিয়েছে। তাদের কী অধিকার আছে?”
মতুয়া এবং রাজবংশী পরিযায়ীদের প্রসঙ্গও টানেন মমতা। তিনি বলেন, “মহারাষ্ট্রে মতুয়াভাষীদের উপর অত্যাচার হয়েছে। নির্বাচনের সময় মতুয়াদের বাড়ি গিয়ে ভোটভিক্ষা করেন। অন্য সময় অত্যাচার করেন। উদয়ন জানেন কত জন রাজবংশীকে বাংলাদেশে পুশব্যাক করা হয়েছে এবং তাঁদের জেলে রাখা হয়েছে।” কেন্দ্রের থেকে এর জবাব চান মমতা। নদিয়ার লোকেদের ছত্তীসগঢ়ে আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন মমতা। দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের জলের লাইন এবং বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ তাঁর। তিনি বলেন, “তাঁদের অন্ধকূপে রেখে দেওয়া হয়েছে।”
মমতা বলেন, “কেউ কাজ করলে তাঁকে হঠাৎ গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নথিপত্র দেখানোর পরেই জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাঁর বয়স্ক মা, স্ত্রী, বাচ্চাগুলোকেও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী অপরাধ করেছে তারা? বাংলা ভাষায় কথা বলেছে। কেন্দ্রের মনে রাখা উচিত, আমাদের রাজ্যেও দেড় কোটির বেশি পরিযায়ী শ্রমিক রয়েছেন। আমরা তাঁদের সঙ্গে কখনও এমন করি না। আমরা ইজ্জত দিই, আর আপনারা বেইজ্জত করেন।”
মমতা বলেন, “আমি বিহারে শুনেছি ৩০.৫ লক্ষ ভোট বাদ দিয়ে দিয়েছে। এ সব করে মহারাষ্ট্রে বিজেপি জিতেছে। না হলে জিততে পারত না। দিল্লিতেও এই সব করেই জিতেছে। বিহারেও সেই পরিকল্পনা করছে। তারাও আমাদের ভাই-বোন। বাংলাতেও পরিকল্পনা করছে। আমরা ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়াই করব। বিনা যুদ্ধে এক ইঞ্চি জমিও আমরা ছাড়ব না।”
অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে মমতা স্মরণ করিয়ে দেন, সীমান্ত বিএসএফের হাতে। বিএসএফ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে। তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে সিআইএসএফ, সিআরপিএফ আছে। বিমানে কেউ এলে, সেটিও কেন্দ্রের অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক দেখে।” তিনি জানান, অনুপ্রবেশ দেখার কাজ কেন্দ্রীয় সরকারের।
মমতা বলেন, “বাঙালিদের উপর এত রাগ কেন? কী করেছে বাঙালিরা আপনাদের? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখিবন্ধন করেছিলেন। ভারত এবং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। জনগণমণ অধিনায়ক কি একজন বাঙালি লেখেননি? তখন তো দেশ একজোট ছিল।”
মমতা বলেন, “বিজেপি কি দেশের জমিদারি পেয়ে গিয়েছে? যাকে ইচ্ছা জেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বাংলা ভাষায় কথা বললে বাংলাদেশি রোহিঙ্গা বলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ তো আলাদা দেশ। রোহিঙ্গা তো মায়ানমারের। তাতে আমাদের এখানে কী! পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের কাছে আধার কার্ড, প্যান কার্ড রয়েছে। আমাদের ২২ লক্ষ বাংলার মজদুর আছেন। তাঁরা বাংলায় থাকলে অনেক ভাল থাকতে পারেন। তাঁদের দিয়ে কাজ করাবে, আর বাংলায় কথা বললেই জেলে নিয়ে যাবে, ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাবে। কেন? কোন অধিকারে? পশ্চিমবঙ্গ কি ভারতের অঙ্গ নয়?”
মমতা জানান, অন্য ভাষাভাষী মানুষদের তিনি সম্মান করেন। প্রত্যেক ভারতীয়কে তিনি সম্মান করেন। কিন্তু বাঙালিদের উপর অত্যাচার তিনি মানবেন না।
মমতা বলেন, “আমি অত্যন্ত লজ্জিত, ব্যথিত, দুঃখিত, মর্মাহত ভারত সরকার এবং বিজেপির এই আচরণে। ভারত সরকার একটি নোটিফিকেশন করেছে। সেটি আমরা চ্যালেঞ্জ করব। লুকিয়ে লুকিয়ে (নোটিফিকেশন) করে যেখানে বিজেপি আছে সেখানে পাঠিয়েছে। সেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছে, যাকেই সন্দেহ হবে, বাংলায় কথা বলে, তাকে অ্যারেস্ট করবে, ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে দেবে। কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলেও (এমন হচ্ছে)।”