মূর্তি-তাণ্ডব থেকে ভোটের ভবিষ্যৎ, চর্চা কফি হাউসে

এক দফা ঝামেলার খবর নিয়েই টেবিলে হাজির হলেন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক সুবিমল সাহা রায়। নিচু গলায় তিনি বলেন, ‘‘ওরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। ও দিকটায় হাঁটা যাচ্ছে না। পুলিশ এখন লাঠি চালাচ্ছে!’’ 

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৯ ০১:৫৫
Share:

আসর: উত্তপ্ত আড্ডায় তখন ভাল-মন্দের লড়াই। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

এমনিতে ভোটের মরসুম। তার মধ্যে কলকাতায় বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের রোড শো যাবে বইপাড়া হয়ে।

Advertisement

পুলিশের গাড়ি আর অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন ফিকে করে দেওয়া গোলমালের শব্দ শুনে সম্বিৎ পাল নামে এক জন টেবিলে রাখা ছাইদানিতে সিগারেট ঘষে উঠে বললেন, ‘‘চল তো, দেখে আসি। মারপিট লেগেছে বোধহয়।’’ সম্ভাব্য ঝামেলার আশঙ্কায় কফি হাউসের প্রায় সব টেবিলের চর্চাতেই তখন বিজেপির রোড শো। মিনিট কয়েক পরে টেবিলে ফিরে সম্বিৎ বলেন, ‘‘এটা মিছিল না ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী! পুলিশ কী করছে?’’

তত ক্ষণে টেবিলে হাজির সরসিজ বসু নামে আর এক জন প্রতিবাদ করে বলে উঠলেন, ‘‘গোটা দেশ জুড়ে ভোট হচ্ছে। কোথায় এ ভাবে বডি পড়ছে? যা ঝামেলা দেখছি, তার সবই তো এই রাজ্যে!’’ আর এক দফা ঝামেলার খবর নিয়েই টেবিলে হাজির হলেন কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক সুবিমল সাহা রায়। নিচু গলায় তিনি বলেন, ‘‘ওরা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। ও দিকটায় হাঁটা যাচ্ছে না। পুলিশ এখন লাঠি চালাচ্ছে!’’

Advertisement

সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে চলতে চলতে এ ভাবেই যেন খানিকটা উত্তাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল বহু আড্ডার স্থল কফি হাউসে। এমনই কয়েকটি টেবিলের ভোট-ভাব বুঝতে সে দিন যাওয়া হয়েছিল কফি হাউসে।

ঘটনার তিন দিন পরেও কফি হাউসের সেই আড্ডা প্রাসঙ্গিক হয়ে রইল ভোটচর্চায়। সে দিনের আলোচনায় উঠে এসেছিল, রাজনীতিতে মানহানির আশঙ্কা যতই বাড়ছে, বাঙালি ততই রাজনীতি-বিমুখ হয়ে পড়ছে। কথা যত এগোয় এই মন্তব্য জল-বাতাস পায় খোদ বর্ণপরিচয়ের স্রষ্টার মূর্তি ভেঙে ফেলার বাঙালির মানহানিকর ঘটনায়। এক জন বলে ওঠেন, ‘‘এ রকম রাজনীতি বাঙালি আগে কবে করেছে? এখন মান সকলের পরে। আগে পেশি আস্ফালন আর পয়সার ঝনঝনানি।’’

মানহানি, রাজনীতি এবং হিংসার মধ্যে যোগসূত্র টানতে গিয়ে সরসিজ বলছিলেন, ‘‘রাজনীতিতে গোলমাল হলে, ভোটেও হবে।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘ভোট আদতে একটি আন্দোলন। আন্দোলন আবার শান্তিপূর্ণ হয় নাকি?’’ গাঁধীর অহিংস আন্দোলনের ভাবনাকে এ ভাবে গঙ্গায় ছুড়ে ফেলার মুহূর্তেই পাল্টা বললেন সম্বিৎ। তাঁর মতে, ‘‘এ সব কথা আমাদের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসকেই আদতে ভুল ব্যাখ্যা করা। রাজনীতি কিন্তু মার-দাঙ্গার জায়গা নয়। তবে আজ যে রাজনীতি হচ্ছে, তাতে এ কথা মনে হওয়া অসম্ভবও নয়।’’

তিনটে চা পাঁচটায় ভাগ করে দিতে বলে আড্ডায় যোগ দিলেন টলিউডের অভিনেতা চণ্ডীদাস কুমার। সিগারেট ধরিয়ে খোশ মেজাজে আড্ডায় বসা তাঁকে দেখিয়ে পার্থসারথি মল্লিক নামে আর এক জন বলেন, ‘‘আজকের রাজনীতিতে এ রকম ভদ্র মানুষ কোথায়? ওঁদের নাকি মত, পড়াশোনা করে রাজনীতি করার দরকার নেই।’’ সরসিজ এই কথার সুর ধরেই বলেন, ‘‘ওরা বলছে, রবীন্দ্রনাথও তো স্কুলে যাননি। রবিঠাকুর পড়েননি, আমিও পড়ব না। ও হে, রবীন্দ্রনাথ আর তুমি এক হলে?’’ তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘আজ যিনি এ দিকে রয়েছেন, পরদিন সকালে উঠেই কাগজে ছবি বেরোয় যে তিনি ও দিকে। এঁরা তো বাবা-মাকেও বদলে ফেলবেন দেখছি!’’ টেবিল থেকে টেবিলে হেঁটে মালুম হয়, রাজনীতির মান পড়া নিয়ে অনেকেই আবার দোষ দিচ্ছেন খোদ সংবাদমাধ্যমকেই। তাঁদের দাবি, ‘‘খারাপ লোককে দেখতে ভাল লাগে। কিন্তু খারাপ লোককে কেন দেখানো হবে, সেটা ভাবা আগে প্রয়োজন।’’

খারাপ লোকের কথার সূত্রেই আলোচনা কফি হাউসের গণ্ডি পেরিয়ে তখন ফের বিজেপি-র রোড শোয়ে। বছর আঠাশের তুহিনা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ভোট কাকে দেব? খারাপকে, নাকি কম খারাপকে? খারাপই যদি বাছতে হবে, তা হলে কীসের এত ভাবনাচিন্তা? মূর্তি ভাঙে যারা, তারা বেশি খারাপ? না কি মূর্তি রক্ষা করতে পারে না যারা, তারা বেশি?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন