ভোটের মুখে কবি-নাম, ‘সাংস্কৃতিক’ প্রচারে শহর

প্রতিপক্ষকে বিঁধতেও দেখা যাচ্ছে, সেই রবীন্দ্রনাথই অস্ত্র। 

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৯ ০১:১৭
Share:

পুষ্পার্ঘ্য: রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে কবিকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন কলকাতা উত্তরের বাম প্রার্থী কনীনিকা বসু ঘোষ। বৃহস্পতিবার, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

প্রার্থীর রোড শোয়ে সচিত্র ট্যাবলোয় বিরাজ করছেন ‘তিনি’! সান্ধ্য প্রচারের চোখা লব্জ পাল্টে ঢুকে পড়ছে তাঁর গান বা কবিতা। বৃহস্পতিবার দিনভর তাঁর জন্মস্থানেও প্রার্থীর মুখ ভেসে উঠছে।

Advertisement

১৫৯-তম জন্মদিনেও এমনই মহিমা রবীন্দ্রনাথের। ফেসবুক-টুইটারে কবিপ্রণামের হিড়িক তো ফি বছর থাকে! ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’-র উদ্ধৃতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা ইঙ্গানুবাদে রাহুল গাঁধীর উদ্ধৃত ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা’ মিলে যাচ্ছে রাজনীতিকদের প্রাক-ভোট প্রচারের ঝাঁঝেও। প্রতিপক্ষকে বিঁধতেও দেখা যাচ্ছে, সেই রবীন্দ্রনাথই অস্ত্র।

তৃণমূলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের ভিডিয়ো-সিরিজ়ের পটভূমি এ দিন যেমন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িই। কবির জন্মস্থানে দাঁড়িয়ে ডেরেক স্মরণ করাচ্ছেন, বিজেপি-র অন্যতম সেনাপতি অমিত শাহ কিন্তু ভুল করে বীরভূমের ‘পুণ্যভূমি’তে রবীন্দ্রনাথের জন্মের কথা বলেছিলেন। তাঁকে খোঁচা দিয়েই ডেরেক বলছেন, এই বিজেপি বাংলার বিন্দু-বিসর্গ জানে না!

Advertisement

কলকাতার ভোটরঙ্গে বিজেপি প্রার্থীরা অবশ্য নিজেদের রবীন্দ্রভক্ত প্রমাণ করতে চেষ্টার কসুর করছেন না। দুপুরে কিছু ক্ষণ জোড়াসাঁকোয় দর্শনার্থীদের জল দিচ্ছিলেন কলকাতা উত্তরের প্রার্থী রাহুল সিংহ। নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র বসুর নাতি কলকাতা দক্ষিণের প্রার্থী চন্দ্র বসু সকালে রবীন্দ্র সরোবরে কবি-মূর্তি বা বিকেলে রবীন্দ্রসদন তল্লাটে ঘুরছেন। সুভাষচন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথের ‘দেশনায়ক’ আখ্যা বা ‘তাসের দেশ’ উৎসর্গের কথা— সবই ঢুকে পড়ছে চন্দ্রের প্রচারে। আর রাহুলের নিদান, ‘‘আজকের রাজনীতির কুকথার স্রোতে সংস্কৃতি বাঁচাতে রবীন্দ্রনাথের ভাষাজ্ঞানই যা ভরসা!’’

কলকাতা উত্তরের পোড়খাওয়া তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা দক্ষিণের মালা রায় থেকে যাদবপুরে রাজনীতিতে নবাগতা-তারকা মিমি চক্রবর্তীও রবি ঠাকুরময়! সুদীপ জোড়াসাঁকোয় ‘কবিপ্রণাম’ সেরে ট্যাংরায় প্রচারে গিয়েছেন। মেয়র ফিরহাদ হাকিমকে সঙ্গে নিয়ে নজরুল মঞ্চ, জোড়াসাঁকো, টাউন হল সফর করছেন মালা। মিমিও হালতুর অনুষ্ঠানে কবির ছবিতে মালা দিচ্ছেন, সভায়-সভায় ‘রবীন্দ্রজয়ন্তীর শুভেচ্ছা’ শোনাচ্ছেন! কলকাতা দক্ষিণের কংগ্রেস প্রার্থী মিতা চক্রবর্তী সন্ধ্যায় ভবানীপুরে যুব কংগ্রেসের সভায় কিছু সাংস্কৃতিক উপাদান রাখতেও বিকেল থেকে ব্যস্ত। ইতিমধ্যে নেতাজিনগরে এক জায়গায় রবিঠাকুরকে তৃণমূল না সিপিএম কারা মালা দেবে, তা নিয়েও মৃদু চাপান-উতোর।

এক দিনের রবীন্দ্রভক্তিতে অবশ্য বিশেষ সায় নেই যাদবপুরের সিপিএম প্রার্থী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের। তিনি হাসছেন, ‘‘কী মুশকিল বলুন তো! আমার তো কোনও বক্তৃতাই রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে শেষ হয় না! বারবারই তো বলছি, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ বা ‘এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে’ থেকেই দেশের সংবিধান বা ভারত রাষ্ট্রের ভাবনাও উঠে এসেছিল।’’

তবু পঁচিশে বৈশাখ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াও এখন প্রার্থীদের বাঁধা রুটিন। কলকাতা দক্ষিণের প্রার্থী নন্দিনী মুখোপাধ্যায়ের বেহালার শীলপাড়ার রোড শো তো সাংস্কৃতিক আসরেরই চেহারা নেয়। রবীন্দ্র-ট্যাবলো, মহিলা সমিতির গান-কবিতা সহযোগে প্রার্থী এগোচ্ছেন। সন্ধ্যায় চেতলার অনুষ্ঠানের আগে নন্দিনী ভাবছিলেন, পূজারিণী আবৃত্তি করলে কেমন হয়!

প্রচারের ফাঁকে বরাবর আবৃত্তি করতে ভালবাসেন কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী কনীনিকা বসু ঘোষও। সকালে রবীন্দ্রনাথের স্কুল চিৎপুর রোডের ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’-র নাগরিক সম্মেলনে তাঁর দিনের শুরু। সন্ধ্যায় এন্টালি, টালাপার্কে রবীন্দ্র-জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে জোড়াসাঁকো-যাত্রা। এক ফাঁকে আবৃত্তিও করলেন একটু। ‘আফ্রিকা’-র শেষ স্তবকে ‘মানহারা মানবী’র পাশে দাঁড়ানোর ডাক গড়গড়িয়ে বলে গেলেন কনীনিকা।

কামারহাটি-খড়দহে দমদমের বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্যের সভাতেও এ দিন ‘রাম নাম’-এর পাশে রবি-নাম! বলছেন, ‘‘রবীন্দ্র-ভাবনার মুক্তকণ্ঠের দেশটাই আসল ভারত!’’ কবি-কবিতা বিষয়ে বিশেষ ‘দুর্বলতা’ শমীকের। কট্টর শক্তি চট্টোপাধ্যায়-ভক্ত তিনি। সভার ফাঁকে নিজের মনেই মুখস্থ বলছিলেন, শক্তির রবীন্দ্র-বন্দনা, ‘রবি ঠাকুরের গান ওরে ভাই, রবি ঠাকুরের ছবি, ঘরে এবং ঘরের বাইরে যখন একলা হবি’! কিন্তু কবিতার শুরুর লাইন যে ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর, নদেয় এল বান...!’

কলকাতার পচা গরমের দুপুরে এই কবিতাটি শোনানোর ঝুঁকি নেননি প্রার্থী!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন