দেখা: মাঝেরহাটের বিপর্যয়ের খবর পেতে মোবাইলে নজর পোস্তা এলাকার বাসিন্দাদের। মঙ্গলবার। নিজস্ব চিত্র
দু’পা অন্তর মোবাইল হাতে জটলা। একে অপরের উপরে ঝুঁকে পড়ে মোবাইলে খবর চালিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন, এই বিপর্যয় কি তাঁদের চোখে দেখা বিপর্যয়ের থেকেও বড়! অস্ফুটে কেউ কেউ বলছেন, ‘‘ওই তো একটা পা দেখা যাচ্ছে! ওই গা়ড়িটা তো এখনও বার করতে পারল না!’’ একজন আবার ভেঙে পড়া উড়ালপুলের একটি থামে উঠে ঘোষণা করে দিলেন, ‘‘প্রচুর লোক আটকে রয়েছেন। আমাদের এখানকার মতোই!’’ কেউ প্রশ্ন করে বসলেন, ‘‘কত জন মৃত?’’
মঙ্গলবার বিকেলে মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ার খবর পৌঁছতেই শোরগোল পড়ে যায় বছর দু’য়েক আগে ভেঙে পড়া পোস্তা উড়ালপুল সংলগ্ন এলাকায়। ভয়ে, আতঙ্কে, দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত ওই এলাকার বাসিন্দারা জটলা শুরু করে দেন মোড়ে মোড়ে। তাঁদের চোখের সামনে যেন ফিরে এসেছে ২০১৬ সালের ৩১ মার্চের পোস্তা উড়ালপুল বিপর্যয়ের ছবি। যে ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ২৬ জনের। জখম হয়েছিলেন অন্তত ১০০ জনেরও বেশি। তবে পোস্তা এলাকার চেহারা বদলায়নি। পোস্তা উড়ালপুলের চারপাশ রয়ে গিয়েছে আগের মতোই। ভাঙা উড়ালপুলের অংশ সরেনি তার আগের জায়গা থেকে।
মঙ্গলবার দেখা গেল, মালোপাড়া হয়ে গণেশ টকিজ মোড় পর্যন্ত দু’পাশের একাধিক দোকানে সন্ধ্যার বিক্রিবাটা বন্ধ। খবরের চ্যানেল খুলে বসে প্রায় সকলেই শহরের বুকে সদ্য ঘটে যাওয়া বিপর্যয়ের ‘তদারকিতে’ ব্যস্ত। ফুটপাতের এক মন্দির লাগোয়া ধূপকাঠির বিক্রেতা বিকাশ মালি দোকান ফেলে ছুটে এসেছেন টিভির সামনে। বললেন, ‘‘আর কত লোক মরলে আমরা জীবনের দাম বুঝব? আর ক’টা সেতু ভাঙবে!’’ চোয়াল শক্ত, চোখ-মুখ রক্তবর্ণ। পোস্তা উড়ালপুলের নীচেই চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছিল বিকাশের বাবা গুলাব মালির। তার পর থেকে সরকারি চাকরির পাশাপাশি সন্ধ্যায় বাবার ধূপকাঠির দোকান সামলান তিনি।
আরও পড়ুন: ‘কেন আজ বই কিনতে গিয়েছিলি?’
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ছেলের ফোন পেয়ে চমকে যান কুমকুম দত্ত। ছেলে ফোনে বলছিলেন, ‘‘মা টিভি চালাও। আবার সেতু ভেঙেছে!’’ টেগোর ক্যাসল স্ট্রিটের বাসিন্দা কুমকুমদেবী বললেন, ‘‘বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল! প্রথমেই মনে হল, ছেলে ঠিক আছে তো!’’ আড়াই বছর আগে পোস্তা উড়ালপুলের তলায় চাপা পড়েই মৃত্যু হয় কুমকুমদেবীর স্বামী তপন দত্তের। ওই দিন সকালে অটোয় কাজে যাচ্ছিলেন তপনবাবু। পোস্তা উড়ালপুলই প্রাণ কেড়েছিল অজয়কুমার কান্দুই এবং তাঁর স্ত্রী সরিতার। তাঁদের পুত্র অভিষেক জানালেন, মাঝেরহাটের ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘উড়ালপুল ভেঙে পড়ায় বাবা-মাকে হারিয়েছি। ফের ব্রিজ ভাঙল! জীবনের কোনও গুরুত্ব নেই!’’
আরও পড়ুন: ‘এই আতঙ্ক কি কাটবে কোনও দিন’
উড়ালপুল হটাও অভিযান সমিতি-র সম্পাদক বাপি দাস বলেন, ‘‘বারবার উড়ালপুল-সেতু ভাঙার ঘটনা ঘটেছে কিন্তু সরকার উদাসীনই।’’
যদিও পোস্তায় সেই মৃত্যু মিছিল এবং এ দিনের ঘটনার পরেও কি হুঁশ ফিরবে প্রশাসনের? আপাতত এটাই বড় প্রশ্ন শহর কলকাতার। ভাঙা উড়ালপুলের নীচের এক চা বিক্রেতা অর্জুন যাদব বললেন, ‘‘সে দিন মরতে মরতে বেঁচেছি। আজকের ঘটনার পরে বারবার মনে হচ্ছে, আবার যদি ওই দৃশ্য দেখতে হয়! জীবনের মূল্য এক কাপ চায়ের থেকেও কম।’’
(শহরের প্রতি মুহূর্তের সেরা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।)