দক্ষিণ দমদম
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগের ঘটনা। দমদমের মতিঝিল এলাকায় কমবেশি ১২০ কাঠার একটি ব্যক্তিগত মালিকানার জমি রয়েছে। সেই জমিটি বামফ্রন্ট আমলে দমকলের জন্য নেওয়া হয়। জমিটির মালিকপক্ষ সরকারের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে জিতে যান। দমকলের অফিস ওই জমি থেকে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হয়। তার পরে মালিকপক্ষ জমিটি এক প্রোমোটারকে দিয়ে দেন। অভিযোগ, সেই প্রোমোটার ওই জায়গায় নির্মাণের কাজ শুরু করার চেষ্টা করতেই স্থানীয় কাউন্সিলর তাতে বাধা দেন। অভিযোগ, ওই কাউন্সিলর প্রোমোটারের কাছে ৩০ লক্ষ টাকা দাবি করেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, ওই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে জমির মালিকপক্ষ ও প্রোমোটার যৌথ ভাবে এক মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেন।
দক্ষিণ দমদম পুরসভা সূত্রে খবর, শুক্রবার দলনেত্রী ইঙ্গিতে আর এক কাউন্সিলরের কথাও বলেছেন, যিনি নাগেরবাজারের বাসিন্দা। নিজেকে ‘রবিনহুড’ বলে দাবি করেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, মাত্র ৪ কাঠা জমিতে প্রোমোটিং করতে চেয়েছিলেন এক প্রোমোটার। ওই কাউন্সিলর তাঁর থেকে ৩০ লক্ষ টাকা চান। সেই ঘটনাটিও তৃণমূল নেতৃত্বের কানে পৌঁছয়।
অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে, সেই দুই কাউন্সিলর আবার রাজ্যসভার এক সাংসদের শিবিরের খাস লোক বলেই পরিচিত। দলীয় সূত্রের খবর, ওই ঘটনার পরেই সরকারি ভাবে নিয়ম করে দেওয়া হয় যে, কোনও নির্মাণের নকশা পাশ করাতে কাউন্সিলরের সইয়ের আর প্রয়োজন হবে না।
উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূলের এক জেলা নেতা শুক্রবার জানান, দক্ষিণ দমদম প্রোমোটিং-এর আঁতুড়ঘর। ছোটোখাটো বাড়ির মালিকও তাঁর বাড়ি প্রোমোটিং-এ দিচ্ছেন। ফলে কাউন্সিলরদের একাংশের লোভ বেড়ে গিয়েছে। ওই নেতার কথায়, ‘‘কার কী উদ্দেশ্য, কে কী করছেন, সবই যে নেত্রীর নজরে রয়েছে বোঝা যাচ্ছে। না হলে এত দিন পরে নেত্রী আচমকাই আজ বোমা ফাটালেন কেন?’’
দক্ষিণ দমদম পুরসভা এই নিয়ে দ্বিতীয় দফায় পরিচালনা করছে তৃণমূল। তবে অভিযোগ, বেনোজল ঢুকেছে ২০০৯ সালে প্রথম দফায় তৃণমূল দক্ষিণ দমদম পুরসভার দখল করার পর থেকেই। পুরসভা সূত্রে খবর, কোনও এক জন কাউন্সিলর নিজের ক্ষমতায় ঠিকাদারকে সুবিধে পাইয়ে দিয়েছেন। আবার দলের নেতৃত্বকে অন্ধকারে রেখে সেই ঠিকাদারকেই কাউন্সিলরের টিকিটও পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। কাউন্সিলরদের কয়েক জন বাড়ির নকশা অনুমোদনের খবর ব্যক্তিগত ভাবে তাঁদের দেওয়ার জন্য ইঞ্জিনিয়ারদের চাপ দিচ্ছেন। কয়েক মাস আগে একটি সরকারি প্রকল্পের জমি এক ব্যক্তির নামে মিউটেশন হয়ে যাওয়ার ঘটনায় নাম জড়ায় এক চেয়ারম্যান পারিষদের। এমন নানা ঘটনার কারণেই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন কথাগুলি বলেছেন বলে দক্ষিণ দমদম পুরসভায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে।
এ দিনের কর্মশালায় মুখ্যমন্ত্রী হাওড়া পুরসভার কাজের প্রশংসা করে বলেন, ‘‘হাওড়ার মেয়র রথীন চক্রবর্তী ভাল কাজ করছেন, কিন্তু ওঁর পাশে যা দুই পিস আছেন না!’’ কোন দু’জনের কথা মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, স্পষ্ট নয়। হাওড়া পুরসভায় মেয়র রথীনবাবুকে বাদ দিলে ৬০ জন কাউন্সিলর তৃণমূলের। মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের মন্তব্যের পরে এক কাউন্সিলরের সহাস্য উক্তি, ‘‘ওই দু’জন কে, তা আমরা কেউই জানি না। তবে সবাই এখন আতঙ্কে ভুগছেন ওই দু’জনের মধ্যে তাঁর নিজের নাম আছে কি না তাই নিয়ে।’’
বিধাননগর
মুখ্যমন্ত্রীর তিরস্কারে কি বন্ধ হবে চিরতরে বন্ধ হবে সিন্ডিকেট-প্রথা? শুক্রবার এক কর্মশালায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র ভর্ৎসনার পরে দিনভর এই প্রশ্নটাই ঘুরপাক খেল বিধাননগরে।
এ দিন ওই কর্মশালায় সিন্ডিকেট ও ডেঙ্গি মোকাবিলায় বিধাননগর পুর নিগমের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন মমতা। বলেন, ‘‘রাজ্যের লোক বিধাননগরের কাছ থেকে সিন্ডিকেট শিখেছে। আপনাদের লজ্জা হয় না?’’
সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে দলের অন্দরে গোলমাল নিয়ে কর্মশালায় মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি যাঁদের নাম উল্লেখ করেন, তাঁরা হলেন বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্ত, বিধায়ক সুজিত বসু, কৃষ্ণা চক্রবর্তী এবং ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায়। সভায় উপস্থিত ছিলেন না শুধু মেয়র। ছিলেন না সিন্ডিকেট-দৌরাত্ম্যে নাম জড়ানো, সব্যসাচীর ঘনিষ্ঠ কাউন্সিলর ডাম্পি মণ্ডলও।
মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের কর্মশালা ছিল মূলত কাউন্সিলরদের নিয়ে। সেখানে খোদ মেয়রই গরহাজির কেন? কেনই বা অনুপস্থিত ডাম্পি? এ দিন মেয়র সব্যসাচী দত্ত ব্যস্ত ছিলেন পুলিশের ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’ অনুষ্ঠানে। প্রশ্ন উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রীর কর্মশালার থেকেও কি পুলিশের অনুষ্ঠান বেশি জরুরি? নাকি কর্মশালা এড়িয়ে গেলেন তিনি? সব্যসাচী বলেন, ‘‘ডাম্পি কেন ছিল না, তা ও-ই বলতে পারবে। তবে পুলিশের অনুষ্ঠানে আমার থাকার কথা আগেই জানিয়েছি। আমার সতীর্থ বিধায়কও ছিলেন সেখানে।’’
দ্বিতীয় দফায় রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তোলাবাজি এবং সিন্ডিকেট-দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সিন্ডিকেট চাঁইরা তো বটেই, গ্রেফতার হয়েছেন খোদ বিধাননগরের কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ও। মেয়র সব্যসাচী দত্ত অবশ্য বরাবরই সিন্ডিকেটের পক্ষে। এমনকী তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘‘সিন্ডিকেট বন্ধ করলে সরকার পড়ে যাবে।’’ যদিও সম্প্রতি মেয়রও ৩১টি নির্মীয়মাণ ‘বেআইনি’ বহুতলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীর কড়া বার্তার পরেও সিন্ডিকেট প্রথা বন্ধ হবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। কারণ, অনিন্দ্যর গ্রেফতারির পরেও সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য, তোলাবাজি, হুমকির ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আরও দুই কাউন্সিলর ডাম্পি মণ্ডল, জয়দেব নস্করের নাম জড়িয়েছে। সল্টলেক, রাজারহাট, নিউ টাউনে পরপর তৃণমূল কর্মীর গ্রেফতারির পরে সাদা চোখে দৌরাত্ম্যের ছবিটা আর নেই ঠিকই। কিন্তু সিন্ডিকেট ছাড়া সল্টলেক থেকে নিউ টাউনে কেউ সরাসরি ইমারতি দ্রব্য এনে নির্মাণ চালাচ্ছে, সেটাও বিরল।
দলীয় কর্মীদের একাংশের বক্তব্য, রাজ্য পদক্ষেপ না করলে সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। মেয়র অবশ্য বলেন, ‘‘সিন্ডিকেটের বিষয় পুরসভার এক্তিয়ারভুক্ত নয়।’’
তবে এ সব ঘটনায় ফের সামনে এসেছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। সকলেই এই সব গ্রেফতারি নিয়ে চাপানউতোরে ব্যস্ত। সম্প্রতি বিধাননগরের ডেপুটি মেয়র তাপস চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ওঠে। যদিও তা খারিজ করেছেন তিনি। এ দিন সকলকে একসঙ্গে কাজ করার বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। দলীয় সূত্রের খবর, কর্মশালায় মমতা বলেছেন, ‘‘ডার্টি গেম খেলবেন না।’’ যদিও মেয়রের দাবি, তাঁদের নিজেদের মধ্যে দন্দ্ব নেই।
তবে সিন্ডিকেট দৌরাত্ম্য থেকে হুমকির ঘটনায় কাউন্সিলরদের নাম জড়িয়ে পড়া নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব যে উদ্বিগ্ন, মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যেই তা স্পষ্ট। মেয়র অবশ্য বলেন, ‘‘কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কিন্তু সব কাউন্সিলরই যদি জড়িয়ে পড়েন, তবে প্রশাসক বসানোই বাঞ্ছনীয়।’’
এ দিন কর্মশালায় ডেঙ্গি রোগ প্রতিরোধে পুরসভার ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। দলের কাউন্সিলরদের চূড়ান্ত বার্তাও দেন। যদিও দলের একাংশের দাবি, পরিকাঠামো নেই। কর্মী নেই। বারবার বলেও সরকারের সাড়া মিলছে না।