শত্রু ক্যানসার, লড়াইয়ে ভরসা মনের জোর ও বন্ধুরা

নিউ টাউনের ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রের ডাক্তারবাবুর নিদান, একটি ওষুধের খরচাই মাসে দু’লাখ। ‘‘আগামী দেড়-দু’বছর এই চিকিৎসা জারি রাখা গেলে রোগীর জীবনের মেয়াদ ও গুণমান, দু’টোই খানিকটা বাড়তে পারে।’’

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৯ ০১:৫৩
Share:

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় (বাঁদিকে)।

আর পাঁচ জন হলে হয়তো নিজের খোলসে গুটিয়েই যেতেন।

Advertisement

ফুসফুসের স্টেজ ফোর ক্যানসার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়েছে জানার পরেও ৩৪ বছরের তরুণ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘অন্ধকারে থাকার থেকে অসুখটা কী অবস্থায় রয়েছে, সেটা জানতে পারাই ঢের স্বস্তির!’’

তবু মনের জোরটাই সব নয়! কঠিন যুদ্ধে টাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। নিউ টাউনের ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রের ডাক্তারবাবুর নিদান, একটি ওষুধের খরচাই মাসে দু’লাখ। ‘‘আগামী দেড়-দু’বছর এই চিকিৎসা জারি রাখা গেলে রোগীর জীবনের মেয়াদ ও গুণমান, দু’টোই খানিকটা বাড়তে পারে।’’— বলছেন সন্দীপনের চিকিৎসক বিভাস বিশ্বাস। ক্যানসার-হামলার চরম পরিস্থিতিতে অসহায় এই রোগীদের ঘিরে সরকারি নীতি কী হওয়া উচিত, সে-প্রশ্নটাও উঠে আসছে সন্দীপনকে ঘিরে। সাম্প্রতিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় যেখানে কিছুটা হলেও জীবনের মেয়াদ বাড়িয়ে রোগীকে এক ধরনের শান্তিময় ব্যথাহীন জীবন উপহার দেওয়া

Advertisement

সম্ভব, সেখানে কত দূর কী করতে পারে সরকার?

সরকারি স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ তাঁদের অসহায়তাই কবুল করেন। এবং সেটাও নেহাত অযৌক্তিক নয়। রাজ্যে বর্তমান রাজনৈতিক জমানায় সরকারি হাসপাতালে কেমোথেরাপির ওষুধ, ক্যানসারের বেশ কিছু অস্ত্রোপচার নিখরচায় সারার সুযোগ হয়েছে। বেশি চাহিদায় চিকিৎসার সুযোগ পেতে কখনও সময় লাগলেও অনেক ক্যানসার রোগীই সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় উপকৃতও হয়েছেন। ‘‘কিন্তু যেখানে খরচটা অস্বাভাবিক বেশি এবং রোগীর জীবনের মেয়াদ বাড়ার সম্ভাবনা ছিটেফোঁটা, সেখানে যে কোনও আকাশছোঁয়া দামের ওষুধের ব্যবস্থা করা সরকারের পক্ষেও অসম্ভব হয়ে পড়ে।’’— বলছেন শীর্ষ স্তরের এক স্বাস্থ্যকর্তা।

তবে সন্দীপনের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিকতম ওষুধটি পড়ার পরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সপ্তাহ দু’য়েক আগের এমআরআই-তে মস্তিষ্কের টিউমার হ্রাস পাওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট। বিভাসবাবু বলছেন, ‘‘এ হল টার্গেটেড থেরাপি। ক্যানসারের বিপদের দিকটা চিহ্নিত করে চিকিৎসার কৌশল ঠিক করা। একেবারে সাম্প্রতিক একটি ওষুধ (থার্ড জেনারেশন) অসিমারটিনিব ওকে ১৯ মাস ধরে খেতে হবে।’’ সন্দীপনের পরিস্থিতিতে আগে দু’চার মাসেই জীবন শেষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এখন জীবন-পর্ব পাঁচ বছরও দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে মনে করেন ডাক্তার। কিন্তু আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাসুদ্ধ ১৯ মাসের ওষুধ খরচ ৪০ লক্ষ টাকা। পিতৃমাতৃহীন সন্দীপনের ছোট ভাই রয়েছেন। সামান্য চাকরিতে ক্যানসারগ্রস্ত যুবার পক্ষে চিকিৎসার বিপুল খরচ মেটানো সম্ভব নয়।

পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের প্রাক্তন ছাত্র সন্দীপনের স্কুল সতীর্থেরা কিন্তু এই লড়াইয়ে হাল ছাড়তে নারাজ। দেশে-বিদেশে অন্য প্রাক্তনীদের সাহায্য নিয়ে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা চলছে। ইন্টারনেটে টাকা জোগাড়ের চেষ্টায় ‘হেল্প আওয়ার ফ্রেন্ড সন্দীপন ডিফিট ক্যানসার’ বলে একটি মঞ্চ গড়ে উঠেছে। এখনও পর্যন্ত মাস ছয়েকের ওষুধের টাকা হাতে এসেছে। স্কুল টিমের ডাকাবুকো ওপেনার সন্দীপনের ব্যাটিংসঙ্গী অমিতাভ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘স্যান্ডি জীবনে সিগারেট খায়নি। ওর সঙ্গে এমনটা হবে, মেনে নেওয়া যায় না!’’

ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ক্যানসারের চরম অবস্থার দামি চিকিৎসায় কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে খানিকটা সরকারি সাহায্য পেলে ভাল হত। অন্তত তরুণ রোগীদের যদি সাহায্য করা যেত!’’ রাজ্যের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র সন্দীপনের বিষয়টা খতিয়ে দেখছেন। ‘‘ক্যানসারের কয়েকটি ক্ষেত্রে রাজ্য সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছে। ওষুধে সন্দীপনের উন্নতির খবর আশাব্যঞ্জক। কী করা নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখব।’’— বলছেন তিনি।

এমনিতে বিস্তর জার্নাল পড়ে, নিজের শারীরিক অবস্থা ও চিকিৎসার খুঁটিনাটি নিয়ে রীতিমতো ওয়াকিবহাল সন্দীপন। ওঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও অবাক, গত ফেব্রুয়ারিতে রোগ ধরা পড়ার পরে একে বারে কাহিল হয়ে পড়া সন্দীপন গত মাসে দু’কেজি ওজন বাড়িয়েছেন। নিউ টাউনে ডাক্তার দেখাতে এসে বন্ধুদের সঙ্গে ঘরের ভিতরে ব্যাট-বলও পিটিয়ে নিয়েছেন প্রাণ খুলে।

‘স্যান্ডি’র মনের জোরে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর হয়ে লড়তে সরকারি-বেসরকারি দোরে দোরে ঘুরছেন বন্ধুরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন