দৃষ্টান্ত ১: চার বিঘা ১৭ কাঠা ৪ ছটাক জমির উপরে ৩৩ হাজার ৭৫৪ বর্গফুট জুড়ে ‘কারখানা’। সম্পত্তিকর বছরে ১৪৪ টাকা!
দৃষ্টান্ত ২: ছ’কাঠা ৮ ছটাক জমিতে ১০০১ বর্গফুটের নির্মাণ। তারও বার্ষিক সম্পত্তিকর ৫৬ টাকা!
দৃষ্টান্ত ৩: এক কাঠা ১০ ছটাক ২৫ বর্গফুটের জমিতে তিনটি ঘর, রান্নাঘর, শৌচাগার-সহ মোট ৯৯৪ বর্গফুটের নির্মাণ। সম্পত্তিকর বছরে ২৪ টাকা। অর্থাৎ, প্রতি তিন মাসে ৬ টাকা করে!
দৃষ্টান্ত ৪: তিন কাঠা জমিতে ১৫৩৪ বর্গফুটের নির্মাণ। তারও বছরে সম্পত্তিকর ৭২ টাকা!
দৃষ্টান্ত ৫: এক বিঘা ১০ কাঠা জমিতে ৬২৫ বর্গফুটের নির্মাণ বাবদ বাৎসরিক সম্পত্তিকর ৫৬ টাকা!
নিছক অভিযোগ নয়, পুরসভার হিসেবের নথিতে লেখা তথ্য।
বালিতে শেষ বার জমি-বাড়ি-সম্পত্তির পরিমাপের মূল্যায়ন হয়েছিল ২০০৫ সালে। তখন বাম পরিচালিত পুরসভার আমল। ২০১৫-র জুলাই মাসে হাওড়ার সঙ্গে সাবেক বালি পুরসভা সংযুক্ত হওয়ার পরে এই নথি এসেছে হাওড়া পুরসভার হাতে। তা থেকেই সামনে এসেছে এই হিসেব।
নথি ঘেঁটে এ পর্যন্ত এমন ৪২ জন জমি-বাড়ি-কারখানা মালিকের সন্ধান মিলেছে বলে দাবি করেছে হাওড়া পুরসভা। পুরকর্তাদের দাবি, এই ৪২টি ক্ষেত্রেই প্রতি তিন মাসে সম্পত্তিকরের পরিমাণ ৫০ টাকার নীচে। অর্থাৎ বছরে ২০০ টাকারও কম।
নিয়মের তোয়াক্কা না করে, সকলকে অন্ধকারে রেখে এ ভাবেই কয়েক জনকে ‘বিশেষ সুবিধা’ পাইয়ে দিয়েছিল তৎকালীন বাম-পরিচালিত বালি পুরসভা।
এমন ‘সুবিধা’ না থাকলে কত টাকা আয় হওয়ার কথা ছিল সাবেক বালি পুরসভার?
হাওড়া পুরসভার রাজস্ব বিভাগ সূত্রের খবর, প্রতি বছর বালিতে সম্পত্তিকর বাবদ প্রায় পাঁচ-ছয় কোটি টাকা আদায় হতো। ওই বিভাগের এক কর্তা বলেন, ‘‘ঠিক মতো নিয়ম মেনে হলে কর নির্ধারণ হলে সংগৃহীত টাকার চেয়ে অন্তত আরও চার-পাঁচ গুণ বেশি রাজস্ব আদায় হতো। অর্থাৎ বছরে ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকা।’’ হাওড়া পুরসভার কর্তাদের অভিযোগ, সাবেক বালি পুরসভার নথি দেখে জানা গিয়েছে, দশ বছর পুনর্মূল্যায়ন না হওয়ার সুযোগেই প্রায় ৩৬ হাজার জমি-বাড়ি মালিকের (ল্যান্ড ওনার) মধ্যে কয়েক জনকে এই ‘সুবিধা’ করের বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়েছিল।
দশ বছরেও কোনও পুনর্মূল্যায়ন করা হয়নি কেন?
সাবেক বালি পুরসভার চেয়ারম্যান, সিপিএমের অরুণাভ লাহিড়ী বলছেন, ‘‘২০১০ সালের আগেই ফের কর পুনর্মূল্যায়নের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ভ্যালুয়েশন বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ে বালিতে ওয়ার্ডের সীমানা পুনর্বিন্যাসের ফলে কাজে সমস্যা দেখা দিয়েছিল বলেই জমি-বাড়ির পরিমাপ করেও আর কর পুনর্মূল্যায়ন করতে পারেনি বোর্ড।’’
হাওড়ার মেয়র পারিষদ (রাজস্ব আদায়) অরুণ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘ট্রেড লাইসেন্সে গরমিল ইতিমধ্যেই ধরা পড়েছে। সন্দেহ হওয়ায় ৫০ টাকার নীচে সম্পত্তিকর দাতাদের তালিকা তৈরি করতেই ফের গরমিল মিলেছে। আসলে বালিতে আলিমুদ্দিন কর চলত। সব টাকা জমা পড়ত বালির ঘুষ-কাণ্ডে ধৃত সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রণব অধিকারীর কাছে।’’
কেমন সেই গরমিল?
কর নির্ধারণ বিভাগের মেয়র পারিষদ শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সাবেক বালি পুরসভার নথি ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, আমিনদের দিয়ে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পুর-এলাকার সমস্ত জমি-বাড়ির পরিমাপ করানো হতো। তৎকালীন ৩৫টি ওয়ার্ডের অধিকাংশ জায়গাতেই নিজের মনের মতো পরিমাপ করে রিপোর্ট জমা দিয়ে দিতেন ওই আমিনরা। কোথাও আবার অর্ধেক কাজ করেই পরিমাপ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়া হতো।
এর জেরেই বিভিন্ন কারচুপি সম্ভব হয়েছে বলে দাবি হাওড়া পুরসভার কর্তাদের। তাঁদের দাবি, এক সময়কার ফাঁকা জমি বা খাটালের জায়গায় পরবর্তী সময়ে বহুতল বা অন্য কিছু তৈরি হলেও নতুন ভাবে পরিমাপ করে নতুন কর ধার্য করেনি সাবেক বালি পুরসভা। যেমন, বেলুড়ের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত জিটি রোডের উপরে একটি তিনতলা বাড়ি রয়েছে। কিন্তু সেটি এখনও ফাঁকা জমি হিসেবেই নথিভুক্ত থাকায় বছরে তার সম্পত্তিকর ‘মাত্র’ ৪০ টাকা।
শান্তনুবাবু বলেন, ‘‘শুধু জমি বা বাড়ি নয়। বালিতে অধিকাংশ বহুতলই সিসি (কমপ্লিশন সার্টিফিকেট) না নিয়েই তৈরি হয়েছে। ফলে সেখানে এখনও শুধু জমিরই কর জমা পড়ছে। বালি পুরসভায় এক জন অফিসারই মিউটেশন, বিল্ডিং নকশা অনুমোদন, কর নির্ধারণ-সহ সব কিছু একাই করতেন। সব মিলিয়ে বালিতে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি চলছিল।’’
অরুণাভবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘নথি না দেখে কার, কেন, কী পরিমাণ কর ছিল, তা বলা সম্ভব নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গ ভ্যালুয়েশন বোর্ড সম্পত্তির পুনর্মূল্যায়ন করে যে কর নির্ধারণ করত, সেটাই নেওয়া হতো।’’
তাঁর আরও দাবি, ‘‘পুনর্মূল্যায়ন না হওয়ায় আমরাও নতুন করের কোনও নথি পাইনি।’’
যদিও এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘কোনও আইনেই ওই সমস্ত সম্পত্তির এত কম টাকা কর হতে পারে না। বালিতে কী ভাবে, কোন আইন মেনে কর নির্ধারণ হতো, তা স্পষ্ট নয়। আর ২০১০ সালে সমস্যা তৈরি হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া হলেও পরে ২০১৫ পর্যন্ত সেই কাজ কেন করা গেল না, তা-ও কারও জানা নেই। তবে এ বার পুর-নিগমের আইন অনুযায়ী কর নির্ধারণ করা হবে।’’
হাওড়ার মেয়র রথীন চক্রবর্তীর কটাক্ষ, ‘‘পুকুর চুরি কথাটাও বোধহয় সাবেক বালি পুরসভার ক্ষেত্রে কম বলা হয়। এঁরা সমুদ্র চুরি করেছেন। তাতে প্রতি মুহূর্তে রাজ্য সরকারকে বঞ্চিত করেছেন। আর টাকার অভাবের দোহাই দিয়ে নাগরিক-পরিষেবায় ফাঁকি দিয়েছেন। এ সব তথ্য সামনে আসার পরে বোঝা যাচ্ছে, কেন বালির মানুষ সুষ্ঠু পরিষেবা পেতেন না।’’
মেয়রের আরও দাবি, ‘‘এই সব কারচুপি দেখেই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে সাধারণ এক জন ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ির মেঝের তলা থেকে, কমোড, সিন্দুকের ভিতরে এত কোটি কোটি টাকা কোথা থেকে এসেছে।’’