জীর্ণ অবস্থা সেতুর নীচের অংশ এবং থামের। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
বাইরে থেকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভাঙা সেতু। এবং চরম বিপজ্জনকও। তার উপরে রীতিমতো সংসার পেতেছেন গোটা পঞ্চাশেক পরিবার। মাঝেরহাট সেতু-সহ রাজ্যের একাধিক সেতু বিপর্যয়ের ঘটনা জেনেও ভ্রূক্ষেপ নেই তাঁদের। আর এমন বিপজ্জনক ভাবে থাকার কারণে যে কোনও সময়ে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা জেনেও পুলিশ, প্রশাসন কেন নীরব, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েও। এলাকাবাসীরা জানান, মাঝেমধ্যে পুলিশ তাঁদের সরে যেতে বললেও কোনও কাজ হচ্ছে না। উল্টে সেতুর উপরে, নীচে থাকা বাসিন্দারা বলছেন, ‘পেট কা সওয়াল হ্যায়। ডরকে কেয়া করুঁ।’
স্ট্র্যান্ড রোডের পাশে আর্মেনিয়ান লঞ্চ ঘাটের কাছে চক্ররেলের উপরে ‘ইউ প্যাটার্নের’ ওই সেতু বহু পুরনো। এক সময় বন্দরের হাতে থাকলেও বর্তমানে তা রেল দফতরের অধীনে। শুক্রবার দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, কংক্রিটের সেই সেতুর নির্মাণ অনেক জায়গাতেই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। লোহায় মরচে পড়ে ক্ষয় হয়ে গিয়েছে। কোনও মতে সেতুর কাঠামো ধরা আছে তাতে। প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া সেই সেতুর উপরে গা ঘেঁষে একের পর এক ঝুপড়ি। কোনওটায় আবার তখনও মশারি টাঙিয়ে শুয়ে রয়েছেন ঝুপড়ির বাসিন্দা। ওই সেতুর উপরেই চলে স্নান থেকে শুরু করে উনুন জ্বালানো, রান্না, খাওয়াদাওয়া, ঘুমনো। এমনকি, আছে ছোট শৌচাগারের ব্যবস্থাও।
শহরে সেতু ভাঙার ঘটনা শুনেছেন। তাতে মানুষ মারাও গিয়েছেন। এর পরেও এই ভাঙা সেতুর উপরে রয়েছেন কোন সাহসে, জানতে চাওয়া হয়েছিল ওই এলাকার বাসিন্দা ফতেমা বিবির কাছে। ওই আস্তানায় তাঁরও একটা ঝুপড়ি রয়েছে। বললেন, ‘‘এক সময়ে আমাদের পরিবার বাংলাদেশে ছিল। সেই কবে কলকাতায় চলে এসেছি। এই শহরের রাস্তাতেই আমাদের জন্ম। বাবা মায়ের কাছে থাকতাম। এখন ওই ভাঙা সেতুই আমাদের বাড়িঘর।’’ আর এক বাসিন্দা আনিসের কথায়, ‘‘যাব কোথায়? কোনও জায়গা নেই। তাই আছি।’’
ওই সেতুর নীচে দিয়ে গিয়েছে চক্ররেলের লাইন। একে ভাঙা সেতু। তার উপরে নীচে ট্রেন চলে। তাতেও হুঁশ নেই সেতুর ঠিক নীচে থাকা একাধিক অস্থায়ী সেলুন
মালিকদের। এক মালিকের কথায়, ‘‘মাথার উপরে বিপদ নিয়েই থাকতে হয়। রোজগার করতে হয় তো।’’ তবে উপরে তাঁরা যে ভাবেই থাকুন না কেন, আশপাশের বাসিন্দারা খুবই অস্বস্তিতে রয়েছেন। কাছেই মল্লিকঘাট ফুল বাজার।
ওই বাজার সমিতির সহ- সভাপতি স্বপন বর্মণ বলেন, ‘‘ওঁদেরকে ওখান থেকে সরিয়ে না দিলে ভয়ঙ্কর বিপদ হতে পারে।’’
তবে ‘ভোট রাজনীতি’-র দৌলতে সকলেরই রেশন কার্ড থেকে ভোটার কার্ড সবই রয়েছে। ওই এলাকা কলকাতা পুরসভার ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে। কাউন্সিলর কংগ্রেসের সন্তোষ পাঠক বলেন, ‘‘অনেক দিন ধরে রয়েছেন ওঁরা। বর্তমান সরকার তো বলে পুনর্বাসন না দিয়ে কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না।’’
পাশেই কলকাতা বন্দরের একটি গুদাম। সেখানে কর্মরত এক নিরাপত্তা অফিসার জানান, জায়গাটি রেলের। দিন কয়েক আগে রেলের ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দল, পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে সেতুর হাল দেখে গিয়েছেন। রেলের এক পদস্থ ইঞ্জিনিয়ার জানান, সেতুর উপরে থাকা বাসিন্দাদের বলা হয়েছে, ২০ দিনের মধ্যে ওই সেতু খালি করে দিতে হবে। তবে ফতেমা-আনিশদের বক্তব্য, ‘‘রেলের অফিসারেরা বলে গিয়েছেন ঠিকই। তবে যাব কোথায়। সরকার আমাদের একটা করে ছোট ঝুপড়ির জায়গা দিন। চলে যাব সেখানে।’’ তবে বিকল্প ব্যবস্থা না হলে তাঁরা যে ভাঙা সেতু ছাড়তে নারাজ তা হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
এখন রেল কী ব্যবস্থা নেয় তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন এলাকার মানুষ।