‘দেখছে খোকা পঞ্জিকাতে এই বছরে কখন কবে/ ছুটির কত খবর লেখে, কিসের ছুটি ক’দিন হবে।’
সুকুমার রায়ের ছড়ার খোকাটি এ যুগের ভারতে জন্মালে তার আহ্লাদের অন্ত থাকত না। ২০১৪ সালে একটি বহুজাতিক সংস্থা ৬৪টি দেশে সমীক্ষা করে দেখায়, সরকারি ছুটির তালিকার দৈর্ঘ্যের নিরিখে ভারত ছিল দ্বিতীয় স্থানে। তার এক বছর পরে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালামের মৃত্যুতে তাঁর প্রতি সম্মান জানাতে সাত দিন রাষ্ট্রীয় শোকপালন করা হলেও ছুটি ঘোষণা করেনি সরকার।
বিবিধ কারণে ছুটি ঘোষণার সরকারি সংস্কৃতির তীব্র বিরোধী কালামসাহেব বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি ভালবেসে থাকো, তবে আমার মৃত্যুতে ছুটি ঘোষণা কোরো না। বরং একটি বাড়তি দিন কাজ কোরো।’ বেশি ছুটির ফলে উৎপাদনশীলতা কমে ও বিনিয়োগ ব্যাহত হয়, এমন যুক্তি দেখিয়ে পোল্যান্ডের মতো কিছু দেশ সরকারি ছুটির সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেকটা কমিয়েছে। ক্ষমতায় এসে নিজের কর্মযোগী ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় সদাব্যস্ত যোগী আদিত্যনাথও তেমনটাই করতে চেয়েছেন উত্তরপ্রদেশে। বিগত কয়েক বছরে ছুটির তালিকায় নিত্যনতুন দিবস সংযোজিত করে পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু উল্টো পথেই হেঁটেছে।
আরও পড়ুন: মানুষকে ভোলাতেই কি এত সব আয়োজন?
ছুটি বা অবসরের সঙ্গে উৎপাদনশীলতা, উৎপাদন এবং আয়ের সম্পর্কটা কিন্তু সব সময়ে একমুখী নয়। অর্থনীতির সহজ যুক্তি বলে, উৎপাদনশীলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অবসরের প্রান্তিক উপযোগিতাও বাড়তে থাকে। অর্থাৎ, মানুষ যত কর্মকুশল হয়ে ওঠে, বাড়তি এক ঘণ্টার অবসর থেকে প্রাপ্ত তৃপ্তি বাড়তে থাকে আরও বেশি করে। অন্য দিকে, কাজের বাজারে তার সময়ের মূল্যও বাড়তে থাকে সমানতালে। তাই এক জন বিচারশীল মানুষ সব সময়ে হিসেব কষে দেখেন, বাড়তি এক ঘণ্টা অবসরযাপন করলে কতখানি আয়ের সুযোগ নষ্ট হয়। অবসর থেকে প্রাপ্ত তৃপ্তির মূল্য সেই আয়ের চেয়ে বেশি হলে তবেই অবসরযাপন করেন তিনি। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা মেলে কলেজপাঠ্য অর্থনীতির যে কোনও বইতে। অন্য দিকে, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অবসরযাপনের ফলে মানুষের উৎপাদনশীলতাও বাড়তে পারে। ঘাড় গুঁজে মাসের মধ্যে ২৬ দিন কাজ করার চেয়ে ১০ দিন সমুদ্রের হাওয়া খেয়ে, বই পড়ে, গান শুনে বা পছন্দ মতো সময় কাটিয়ে বাকি দিনগুলিতে কাজ করলে উৎপাদন বাড়ে বই কমে না। সেই কারণেই হয়তো এ দেশেও কতিপয় কর্পোরেট সংস্থা মইয়ের উচ্চতম ধাপের কর্মীদের সুইৎজারল্যান্ডে বেড়াতে পাঠায় গাঁটের কড়ি খরচ করে।
আরও পড়ুন: সেরার দৌড়ে পশ্চিমবঙ্গ, ছুটিতে ধারেকাছে নেই প্রায় কেউই!
তবে বলাই বাহুল্য, কলেজপাঠ্য অর্থনীতি বা উন্নত বিশ্বের কাজের বাজারের সঙ্গে ভারতের কাজের বাজারের ফারাক বিস্তর। বাজারে নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী শ্রম বা অবসরের ক্ষণ এবং দৈর্ঘ্য বেছে নেওয়ার স্বপ্নটি এ দেশে আগাগোড়াই অলীক। রোজগার এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার মতো অবসর বা ছুটির ক্ষেত্রেও লক্ষ করা যায়, ভয়ানক অসাম্য। সরকারি ছুটির তালিকাটি যতই দীর্ঘ হোক না কেন, অসংগঠিত শ্রমের বাজারে এবং বেসরকারি ক্ষেত্রের একটা বড় অংশে পছন্দমতো অবসরযাপনের সুযোগ একেবারেই সীমিত। জানতে ইচ্ছা করে, মনীষীদের জন্মদিন এবং বিবিধ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাঁরা ছুটি পান (সরকারি হিসেব অনুযায়ী এ বছর এ রাজ্যে শনি ও রবিবার বাদ দিয়ে তেমন ছুটির সংখ্যা ছিল ৩৪), বাড়ির পরিচারিকা এক দিন বাড়তি ছুটি চাইলে তাঁরা কি বিরক্ত হন না? আবার সরকারি ছুটি মানে স্কুল-কলেজেও ছুটি। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, একটি বাড়তি দিন বিদ্যায়তন বন্ধ থাকলে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্রতম পরিবারের ছেলেমেয়েরা।
বেশি ছুটি পেলে কর্মদিবসে সরকারি কর্মীদের কাজের মান এবং কর্তব্যনিষ্ঠা বাড়বে, এই তত্ত্বটি গ্রহণযোগ্য নয় অনেকের কাছেই। যাচাই করে দেখার সোজাসাপ্টা উপায়ও নেই। অনেকেই মনে করেন, বাড়তি ছুটি শুধুমাত্র সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণিকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নামান্তর। আবার ঘোষিত ছুটি নয়, এমন এক সাধারণ কর্মদিবসেও অবসরযাপনের সুযোগ থাকতে পারে বিস্তর। মনে পড়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আদায়ের ইতিহাস’ উপন্যাসের ধীরেন চরিত্রটির কথা। টাইপিস্ট ধীরেন দু’-তিন মিনিট বিদ্যুৎগতিতে টাইপ করে আট-দশ মিনিট বসে থাকে, গল্প করে আর ইয়ার্কি মারে। ‘মাঝে মাঝে দশ বিশ মিনিট দ্রুত একটানা টাইপ করিয়া হাতের কাজ শেষ করিয়া, কাগজগুলি ঘণ্টাখানেক ফেলিয়া রাখে, তারপর ধীরেসুস্থে কর্তাদের কাছে পাঠাইয়া দেয়। মন্থর গতিতে সে টাইপ করিতে পারে না, আঙ্গুল বাগ মানে না।’ আন্দাজ করে নেওয়া যায়, ছুটির তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলে ধীরেনের মতো কর্মীদের পুলকের শেষ থাকে না।
তবে সাধারণ ভাবে সরকারি কর্মীরা সকলেই টাইপিস্ট ধীরেনের মতো অবসর খুঁজে নেন বা ছুটির জন্য মুখিয়ে থাকেন, এমন অতি সরলীকরণ অর্থহীন। শতকরা হিসেবে তাঁরা কত জন, তা জানার উপায় না থাকলেও উল্টো দিকেই রয়েছে ‘নিউটন’ ছবির নূতন কুমারের মতো চরিত্রেরা। যেখানে উৎপাদনশীলতা মাপা হয় না অথবা সাধ্যমতো কাজ না করলে আর্থিক বা অন্য কোনও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না, সেখানেও তাঁরা নিরলস এবং কর্তব্যনিষ্ঠ ভাবে কাজ করে যান যার জন্য, তা নিয়ে উন্নয়নচর্চায় গবেষণাও হচ্ছে বিস্তর। সেই জিনিসটির নাম ‘রেসপন্সিবিলিটি’ বা দায়িত্ববোধ। অমর্ত্য সেন স্পষ্ট ভাবে যার তফাত করে থাকেন ‘অ্যাকাউন্টেবিলিটি’ বা দায়বদ্ধতার সঙ্গে। ধরেই নেওয়া যায়, চাপিয়ে দেওয়া বাড়তি ছুটির ফলে এঁরা বাড়তি পুলক অনুভব করেন না। সুকুমার রায়ের ছড়ার সেই খোকার মতো বছরের গোড়ায় ক্যালেন্ডারে লাল তারিখ গুনতেও বসেন না।