আইন আগে না আবেগ, ভাবাচ্ছে একরত্তি মেঘলা

আবেগ না নিয়ম— কে জিতবে? আপাতত এই টানাপড়েনে আরজিকর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মানবিক সম্পর্কের বিচিত্র বুনন দেখে কিছুটা উদ্বেল কলকাতা শিশু নিরাপত্তা কমিটিও (সিডব্লিউসি)। সরকারি বিধির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তা কার্যকর করাই তাদের কাজ। কিন্তু ভালবাসার দাবির সামনে মন পিছলে যাচ্ছে কমিটির পোড় খাওয়া সদস্যদেরও।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:১০
Share:

হাসপাতালে মেঘলা

আবেগ না নিয়ম— কে জিতবে? আপাতত এই টানাপড়েনে আরজিকর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মানবিক সম্পর্কের বিচিত্র বুনন দেখে কিছুটা উদ্বেল কলকাতা শিশু নিরাপত্তা কমিটিও (সিডব্লিউসি)। সরকারি বিধির প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তা কার্যকর করাই তাদের কাজ। কিন্তু ভালবাসার দাবির সামনে মন পিছলে যাচ্ছে কমিটির পোড় খাওয়া সদস্যদেরও।

Advertisement

মেঘলা চলে যাবে না তো! এই আশঙ্কাতেই এখন কাঁটা হয়ে রয়েছে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগের ‘লেবার জেনারেল ওয়ার্ড ১’-এর চিকিৎসক, নার্স, আয়ারা। এই মেঘলা চলে গেলে যে আর আলো ঝলমলে থাকবে না তাঁদের চারপাশটা। বরং আঁধার নেমে আসবে তাঁদের মনে। তাই মেঘলাকে যেন কোনও হোমে না পাঠিয়ে আপাতত তাঁদের দায়িত্বেই রাখা হয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সিডব্লিউসি-র কাছে এমন আবেদনও জানিয়েছেন স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসকেরা। এই ডামাডোলে মা-বাবা হারানো মেঘলাকে সুযোগসন্ধানী কেউ যাতে তুলে না নিয়ে যায়, তার জন্য রাতে দু’জন করে নিরাপত্তাকর্মী পাহারায় থাকছেন বেবিকটের দু’পাশে।

এগারো মাসের ফুটফুটে মেয়ে এই মেঘলা। আদর করে নামটা দিয়েছেন হাসপাতালের ডাক্তারেরাই। গত বছর ১০ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল চত্বরের এক ধারে প্রসববেদনায় কাতরাতে দেখে মেঘলার মাকে স্ত্রীরোগ বিভাগে নিয়ে আসেন হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী। ওই দিন বিকেলে সেখানেই জন্মায় মেঘলা। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শ্যামল চক্রবর্তী জানালেন, মানসিক সমস্যা ছিল মেঘলার মায়ের। কোনও কিছুই মনে করতে পারছিলেন না তিনি। নিজের নামও বলতে পারেননি। শুধু জানিয়েছিলেন, নেপাল সীমান্তে পানিট্যাঙ্কি এলাকায় তাঁর বাড়ি ছিল। কলকাতায় একটি খালের ধারে কোনও বাড়িতে থাকতেন। ব্যাস, এইটুকুই!

Advertisement

মেয়েকে ঠিকঠাক দেখাশোনাও করতে পারতেন না মা। তাই শ্যামলবাবুর পাশাপাশি মেঘলাকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে নেন চিকিৎসক সোমনাথ লাহা, নীলাঞ্জন ঘোষ ও সুস্মিতা দাস। তাঁদের সাহায্য করেন কয়েক জন আরএমও, পিজিটি, নার্স এবং আয়া। লেবার ওয়ার্ডের মধ্যেই একটি শয্যার ব্যবস্থা হয় মা ও মেয়ের জন্য। মেঘলা যাতে পড়ে না যায় তাই নিজেরাই মিস্ত্রি ডেকে খাটের চারপাশে রেলিং বসিয়ে দেন চিকিৎসকেরা। কেনা হয় খেলনা, জামাকাপড়। হাসপাতাল থেকে বিনাপয়সায় খাবার ও ওষুধপত্র আসতে থাকে দু’জনের জন্যই। একটু একটু করে আরজিকরেই বড় হতে থাকে মেঘলা।

ডেপুটি সুপার সুপ্রিয় চৌধুরী জানালেন, সেই সময়ে এক বার মেঘলাকে হোমে পাঠানোর কথা উঠেছিল। কিন্তু তখন মেঘলার মা ছিলেন। তাই সেই দফায় বিষয়টি আটকানো গিয়েছিল। হাসপাতালের সকলেরই আদরের পাত্রী হয়ে উঠেছিল পুঁচকে মেয়েটি। সমস্যা তৈরি হয় গত ৪ জানুয়ারি। সকাল ১০টা নাগাদ হঠাৎ হাসপাতাল থেকে উধাও হয়ে যান মেঘলার মা। অনেক খুঁজেও তাঁকে আর পাওয়া যায়নি। এ বার সিডব্লিউসি-কে না জানিয়ে আর উপায় নেই। খবর দেওয়া হয়েছে স্থানীয় থানাতেও। সেই থেকেই মেঘলার চলে যাওয়ার আশঙ্কায় ত্রস্ত হয়ে রয়েছেন চিকিৎসক ও কর্মীরা। ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল, টুকটুকে লাল জামা পড়ে সকলের কোলে কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। কখনও হাত বাড়িয়ে ধরতে যাচ্ছে, কখনও খিলখিল করে হাসছে, কখনও আবার আহ্লাদে ঠোঁট ফোলাচ্ছে। স্ত্রীরোগ বিভাগের চিকিৎসকেরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন, তাঁদের কাছেই যেন মেঘলাকে রাখা হয়। তাঁরা সকলে মিলে তাঁকে লেখাপড়া শেখাবেন, বড় করবেন। তাঁদের অনুরোধ, কর্তৃপক্ষ যেন একটু সিডব্লিউসি-র থেকে অনুমতি আদায় করেন।

সব শুনে সিডব্লিউসি-র কর্তারাও আবেগে ভেসেছেন। কিন্তু আইনের বাইরে যাওয়ার অধিকার নেই তাঁদেরও। কলকাতা সিডব্লিউসি-র সদস্য অমিত ভট্টাচার্যের কথায়, শিশুটিকে হাসপাতালে তো রাখাই যাবে না। তাকে সিডব্লিউসি-র নজরদারিতে কোনও হোমে রাখতে হবে। তার ছবি দিয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। বাড়ির লোক কেউ আসে কি না
তার জন্য দু’মাস অপেক্ষা করতে হবে। তার পরে দত্তক দেওয়ার কথা ভাবা হবে। হাসপাতালের সকলে মেঘলার জন্য যা করছেন, তার প্রশংসা করে
শিশু নিরাপত্তা কমিটির সদস্যেরা বলেছেন, হাসপাতালের এই বিরল আত্মীয়তাকে সম্মান দিতেই সমাজকল্যাণ দফতরের উচ্চপদস্থ কর্তাদের সঙ্গে এক বার বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন তাঁরা। তবু শেষ পর্যন্ত যদি আইন মেনেই এগোতে হয়, তা হলে মেঘলার চলার পথ যেন খুব কঠিন না হয়, তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করার আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন