Kolkata News

প্রবাসে থাকার সময় আরও বেশি করে বুঝেছি কলকাতা কতটা আপন

কলকাতার নিকটবর্তী মফস্সলের মেয়ে আমি। আমার জন্ম নৈহাটির কাছাকাছি ভাটপাড়ায়। ট্রেনে কলকাতা থেকে যার দূরত্ব এক ঘণ্টার। ছেলেবেলায় কলকাতা মানেই বছরে একবার গাড়িতে চেপে বাড়ির সবাই মিলে থিয়েটার দেখতে যাওয়া। সে যেন এক উৎসবের দিন!

Advertisement

মুনমুন মুখোপাধ্যায় (বাচিক শিল্পী)

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৫:০২
Share:

কলকাতার নিকটবর্তী মফস্সলের মেয়ে আমি। আমার জন্ম নৈহাটির কাছাকাছি ভাটপাড়ায়। ট্রেনে কলকাতা থেকে যার দূরত্ব এক ঘণ্টার। ছেলেবেলায় কলকাতা মানেই বছরে একবার গাড়িতে চেপে বাড়ির সবাই মিলে থিয়েটার দেখতে যাওয়া। সে যেন এক উৎসবের দিন! যা ইচ্ছে খাওয়া, ট্রাম দেখা, দোতলা বাসের সঙ্গে পরিচয়, আরও কত কী... আর হ্যাঁ, ওই বড়দের হাত ধরেই বছরে একবার বইমেলাতে এত্ত এত্ত নতুন বইয়ের গন্ধ চিনতে শেখা।

Advertisement

কলকাতার সঙ্গে শৈশবের পরিচয়টা এভাবেই। তখনও কলকাতা নিজের শহর হয়ে ওঠেনি। অত লোক, অত ভিড়! একটু যেন আড়ষ্টতা। ওই ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয়। কৈশোরে বুঝলাম, সেরা জিনিসগুলো হয়তো কলকাতাতেই পাওয়া যায়। পুজোর শপিং করতে কলকাতা। সে রোদ-জলে পুড়ে হাজার কষ্ট করে হলেও। স্কুল কলেজের সেশন শুরুতে বই কিনতে কলকাতার বইপাড়ায়। পুজোর ঠাকুর দেখতেও সেই কলকাতা। ভিড় ঠেলে, সারা দিন লাইনে দাঁড়িয়ে হলেও...

আরও পড়ুন, বহুক্ষণ খোঁজ নেই প্রিয়জনের? ফোন করুন মেট্রোর মোবাইল নম্বরে

Advertisement

তবে এ সবের চেয়েও বেশি বার কলকাতায় আসা কবিতার টানে। কবিতার দুঃষ্প্রাপ্য বইয়ের খোঁজে কলেজ পাড়া, ছুটির দিনে আবৃত্তির ক্লাস করতে আসা, আবৃত্তির অনুষ্ঠান দেখতে রবীন্দ্রসদন— এই সব কিছু করতে করতে কখন যেন শহরটা এক্কেবারে নিজের হয়ে গেল! তার পর তো এক সময় কলকাতাবাসী হয়ে যাওয়া। যত বড় হয়েছি তত দেখেছি নানান বৈপরীত্য আমার এই শহরটা জুড়ে। এক দিকে পার্ক স্ট্রিটের চোখ ধাঁধানো আলো, ঝলমলে শহর, তারই অন্ধকার কোণে হাত পেতে দুই পয়সার আশায় বসে থাকা মানুষ। এক দিকে প্রতিদিন গড়ে ওঠা নতুন নতুন বহুতল, অন্য দিকে তারই ফুটপাতে সর্বহারাদের সংসার। সেখানেই দিন শেষে আগুন জ্বালিয়ে ভাত ফোটানো, দেশি বিদেশি ঝাঁ চকচকে গাড়ি, আবার অফিস টাইমে সেই গাড়ির যানজটেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। বর্ষার দিনে কাদা-জলে ভেজা কলকাতায় এক হাঁটু জল।

বড় হওয়ার পর রাতের কলকাতা বড্ড টানত আমায়। কর্মস্থল একেবারে দক্ষিণে আর বাড়ি উত্তরে। মাঝরাতে যখন শুটিং শেষে ফিরতাম, আজও ফিরি অদ্ভুত মায়াবী লাগে কলকাতাকে। আর কোনও শহর ভারতবর্ষের মধ্যে বা বাইরে কখনও এমন ভাবে টানেনি, এত মায়াবি লাগেনি। এ বোধটা আরও বেশি কারণ মাঝের বেশ কয়েকটা বছর প্রবাসে কাটাতে হয়েছে। আর সেখানে গিয়ে আরও বেশি করে, আরও অনেক অনেক বেশি করে বুঝেছি কলকাতা কতটা আপন। ধুলো ধোঁয়া, যানজট, প্যাঁচপ্যাঁচে গরম, বর্ষার এক হাঁটু জল, লোড শেডিং, দারিদ্র্য— তবু তার মধ্যেই প্রাণ ভরে শ্বাস নিতাম যখন আমার এই শহরটায় ক’দিনের জন্য ফিরতাম। বিদেশের সুসজ্জিত ঝাঁ-চকচকে বৈভবে মোড়া শহরটাকে এক দিনের জন্যেও আপন ভাবতে পারলাম না কখনও। এখানকার অটো, টোটো, রিকশাতে চড়ে যে চওড়া হাসিটা আসত, তা কখনও দামি বিদেশি গাড়িতে চেপেও এক মুহূর্তের জন্যও আসেনি।

একটা কবিতা আবৃত্তি করেছিলাম দুবাইতে থাকার সময়েই, তসলিমা নাসরিনের ‘কলকাতা প্রিয় কলকাতা’। কবিতাটাই তার পর সাড়া পৃথিবী জুড়ে স্যোশাল মিডিয়াতে শেয়ারিং হয়েছে, বিশেষত অনাবাসী বাঙালিদের মধ্যে। প্রথম লাইন ছিল ‘কলকাতা কেমন আছ তুমি?’। নির্বাসিত ছিলাম না, কেউ জোর করে শহরটা থেকে বার করে দিয়েছেন তেমনও নয়। তবু প্রয়োজনের তাগিদে কলকাতা ছেড়েও হয়তো আমার আত্মাই, মননে-জীবনে নির্বাসিতই হয়ে যায়। আর অসীম তৃষ্ণা থেকে সেই শহরটার প্রতি, যেখানে থেকে তার আগে বহু বছর ধরে শুধু অপ্রাপ্তিরই হিসেব করে এসেছি। কিন্তু খুব আপনজন যেমনই হোক, সে তো সব সময় নিজেরই। ঠিক তেমনই আমার শহরটা ভাল-মন্দে আমারই, আমাদের একান্ত আপন। তাই আর কখনও ভেজা চোখে একান্তে, নিভৃতে দূর দূ-উ-র থেকে তাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই না— ‘কলকাতা কেমন আছ তুমি’?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন