শুধু বিরোধীরা নন, ভয় পেয়ে খোদ শাসক দলেরই প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন, তার নিদর্শন বোধহয় তেমন নেই। ব্যতিক্রম উত্তর ব্যারাকপুর পুরসভা। খোদ মন্ত্রী তথা তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকেরই অভিযোগ, ভয় দেখিয়ে শাসক দলের ভোট কেড়ে নেওয়ার ঘটনা রাজ্যে একমাত্র এখানেই ঘটেছে।
১২০ বছরের এই পুরসভায় বিদায়ী বোর্ডেই প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। এই পরিস্থিতিতে এ বারের পুরভোট তাই ‘প্রেস্টিজ ফাইট’। বিদায়ী চেয়ারম্যান মলয় ঘোষ বলেন, ‘‘২৩টা ওয়ার্ডের সবকটাতেই জিতব। বিরোধীদের এবার আর দেখতে পাওয়া যাবে না। পাঁচ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে সেটাই আমাদের জেতার অস্ত্র। তাই ভয় দেখিয়ে ভোট কাড়ার প্রশ্নই নেই।’’
মলয়বাবু যে ওয়ার্ড থেকে জিতে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, সেই ২ নম্বর ওয়ার্ড এ বার মহিলা-সংরক্ষিত। বিদায়ী চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন ৪ নম্বরে। ২ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী মলয়বাবুদেরই প্রস্তাবিত অর্পিতা রাজবংশী। সিপিএমের প্রার্থী কল্পনা রাজবংশী। জোড়া পাতায় নির্দল প্রার্থী হন মায়াপল্লির বাসিন্দা চম্পা দাস। প্রায় রাতারাতিই বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় বিজয়ী কাউন্সিলরও তিনি। কারণ, শাসক-বিরোধী সব প্রার্থীই মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। স্থানীয় সূত্রে খবর, চম্পার স্বামী গোপাল দাসের ভয়েই এমন ঘটেছে। একাধিক খুন ও অসামাজিক কাজের জন্য এখন জেলবন্দি গোপাল এক সময়ে বামেদের আশ্রয়ে থাকলেও রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে নিজের অবস্থান বদলেছিল।
নাম প্রত্যাহারের পর থেকে অর্পিতাদেবী, কল্পনাদেবীদের বাড়ি গিয়েও খোঁজ মেলেনি। খোঁজ মেলেনি চম্পাদেবীরও। উত্তর ব্যারাকপুরে প্রচারে গিয়ে জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, ‘‘এটা নিয়ে ভোটের আগে আমরা কিছু করিনি। কারণ তাতে অশান্তি হতো, যার সুযোগ নিত সিপিএম। ভোট মিটে যাওয়া পর্যন্ত মুখ বুজে থাকব। পরে যা ব্যবস্থা নেওয়ার, আমরা নেব। কত বড় ক্ষমতা! ভয় দেখিয়ে এক জন জনপ্রতিনিধি হয়ে যাবে! আমরা তো ক্ষমতায় থেকেও ভাবতে পারি না।’’ সিপিএম নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও বিজেপি যে প্রতিবন্ধকতা নয়, গত লোকসভা ভোটের নিরিখেই তা স্পষ্ট। মোদী-ম্যাজিক ৬, ৭, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি-কে অনেকটা এগিয়ে রাখলেও তৃণমূলের সঙ্গে তাদের ব্যবধান ছিল ভালই। পুর-নির্বাচনে বিজেপি এই অঞ্চলে সাংগঠনিক ভাবেও তেমন জায়গা করতে পারেনি। তুলনায় তৃণমূলের চাপা পড়া গোষ্ঠীকোন্দল প্রকাশ পেলে সিপিএম আগের থেকে ভাল ফল করতে পারে বলে মত অনেকের। বিজেপির উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি অশোক দাস বলেন, ‘‘আমাদের তো গোড়া থেকেই চাপে রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক জীবন যাপনই করতে পারছেন না কর্মীরা। প্রচার করবেন কী করে? ভয়ে শাসকদল যা করছে, তা নজিরবিহীন।’’
১২.২২ বর্গকিমি জুড়ে এই পুর-এলাকার জনসংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার। ১৯৯৫ সালে সংলগ্ন মোহনপুর পঞ্চায়েতের কিছু অংশ এই পুরসভায় সংযুক্ত হয়। ১৯৮১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টানা বামেদের দখলে থাকা এই পুরসভায় চার বারের চেয়ারম্যান ছিলেন মদনমোহন নাথ। ২০০০-২০০৫ কংগ্রেস ও তৃণমূলের বোর্ড থাকলেও চেয়ারম্যান ছিলেন কংগ্রেসের মধুসূদন ঘোষ। ২০০৫-এ ভোটের হাওয়ার দাপট মধুবাবুকে জেতালেও বোর্ড ধরে রাখতে পারেনি। ফের বামেরা এই পুরসভা ছিনিয়ে নেয়। চেয়ারম্যান হন সমরেন্দ্রমোহন সান্যাল। ২০১০-র নির্বাচনে ১৫টি আসনে জিতে একক ভাবে বোর্ড গড়ে তৃণমূল। কংগ্রেস পেয়েছিল ৪টি, সিপিএম ৩টি এবং নির্দল ১টি। কংগ্রেসের ৩ জন কাউন্সিলর পরে তৃণমূলে যোগ দেন।
এ বার তৃণমূল ও বামেরা সব ওয়ার্ডে প্রার্থী দিলেও বিজেপি ও কংগ্রেস পারেনি। কংগ্রেসের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক বিপুল ঘোষাল বলেন, ‘‘প্রার্থীদের ভয় দেখানো হচ্ছে গত নির্বাচনের পর থেকেই। বাধ্য হয়ে অনেকে দল ছেড়েছে। এমন চাপা সন্ত্রাসের পরিবেশে প্রচার করতেও ভয় পাচ্ছি আমরা।’’ সিপিএমের এক সময়কার দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা, প্রাক্তন সাংসদ তড়িৎ তোপদার বলেন, ‘‘ঠিক ভাবে ভোট হলে আমরাই একক ভাবে বোর্ড গড়ব।’’
ভোট ঠিকমতো হবে কি না, সেই বিতর্ক রেখে একটা কথা পরিষ্কার। এ বারও লড়াই হবে সেয়ানে সেয়ানে।