শহরের পথে সিএসটিসি-র সেই বাস। —নিজস্ব চিত্র।
রবিবারে ট্যাক্সির দেখা পাওয়া ভার। ছুটির দিনে অফিস আসতে তাই নিজের গাড়ি নিয়েই বেরোতে হত সুজয় বসুকে। যেতে-আসতে প্রায় ২৫০ টাকার তেল পুড়ত তাঁর। গাড়ি রাখতে পার্কিংয়ে খরচ হত আরও ৫০ টাকা।
সকালের ব্যস্ত সময়ে বাসে উঠতে নাজেহাল হতেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার চাকুরে অনির্বাণ বিশ্বাস। মধ্যমগ্রামের বাড়ি থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভের অফিস যেতে নিজের গাড়ি বা ট্যাক্সির উপরেই ভরসা করতে হত তাঁকে।
সুজয়-অনির্বাণদের এই রোজনামচা অবশ্য মাস দুয়েক ধরে বদলে গিয়েছে। সৌজন্য সিএসটিসি-র নতুন বাতানুকূল বাস। মাস দুয়েক আগে শহরের বিভিন্ন রুটে ১০৮টি নতুন এসি বাস নামিয়েছে এই সরকারি পরিবহণ সংস্থা। ভাড়া সাধারণ বাসের তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি। কিন্তু সংস্থার কর্তারা বলছেন, অফিসের ব্যস্ত সময়ে নতুন বাসগুলিতে ভালই যাত্রী পাচ্ছেন তাঁরা। তার হাত ধরে বদল এসেছে সিএসটিসি-র আর্থিক ছবিতেও। সংস্থা সূত্রের খবর, সাধারণ বাস চালাতে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়েছিল সিএসটিসি। নতুন বাসের ভাড়া থেকে আপাতত মাসে কয়েক লক্ষ টাকা বেশি রোজগার হচ্ছে সংস্থার।
বাস ভাড়া বাড়ানো নিয়ে এ রাজ্যে প্রশাসনের নৈতিক অবস্থান খুবই স্পষ্ট। টানা কয়েক বছর ধরে বাস মালিকদের নানা হুমকি-ধর্মঘটের পরে অবশ্য স্তর প্রতি এক টাকা করে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের অনেকেই বলছেন, পরিষেবা উন্নত হলে বেশি ভাড়া দিতে আপত্তি নেই তাঁদের। এসি বাসের ভিড় তারই প্রমাণ বলে অনেকে দাবি করেছেন।
বিষয়টা যে সত্যি, তা সপ্তাহের যে কোনও কাজের দিনে তথ্যপ্রযুক্তি তালুকে দাঁড়ালেই মালুম হবে। প্রতিটি অফিসের সামনে বাস স্টপে সকাল-সন্ধ্যায় এই বাসে ওঠার জন্য রীতিমতো লাইন পড়ে যায়। এমনই এক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার এক কর্মী বলেন, “আমাদের অফিসের অনেকেই আগে গাড়ি নিয়ে আসতেন। কিন্তু এখন এসি বাসেই যাতায়াত করেন।” বিভিন্ন কর্পোরেট সংস্থার কর্মীরা বলছেন, অফিসে গাড়ি নিয়ে যাতায়াত করতে মাসে কয়েক হাজার টাকার তেল পোড়ে। পার্কিং-ফি বাবদ আরও কয়েক হাজার টাকা খরচ। “এসি বাসের ভাড়া সাধারণ বাসের থেকে বেশি হলেও গাড়িতে যাতায়াতের তুলনায় সাশ্রয়কর। ট্যাক্সির থেকে অনেক বেশি আরামে যাতায়াত করা যায়।”—মন্তব্য এক তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীর।
নিউ টাউন ও সেক্টর ফাইভে এই বাসের চাহিদা যে বেশি, তা জানিয়েছেন সিএসটিসি-র কর্তারাও। সংস্থার এক শীর্ষকর্তার বক্তব্য, “সেক্টর ফাইভের কয়েকটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা আমাদের বলেছে অফিসের সময়ে বাসের সংখ্যা বাড়াতে। তাঁরা জানিয়েছেন, আগের তুলনায় ৬০ শতাংশ কম কর্মী নিজের গাড়িতে যাতায়াত করছেন।” সিএসটিসি জানিয়েছে, এই বাসের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা চলছে। বিশেষত সকাল ৮টা থেকে বেলা ১২টা এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বাসের সংখ্যা বাড়ানো হতে পারে বলে সিএসটিসি সূত্রের খবর। পাশাপাশি নিজেদের ওয়েবসাইটেও বিভিন্ন রুটে বাসের সময়সারণী প্রকাশ করবে সংস্থা। “সেই সময়সারণী দেখে লোকেরা সময় মতো বাস ধরতে পারবেন।”মন্তব্য এক সিএসটিসি কর্তার।
শুধু পরিষেবা বা পরিবহণ সংস্থার আর্থিক লাভই নয়, নাগরিকদের এই গণ পরিবহণ ব্যবহার পরিবেশ সহায়ক হবে বলেও অনেকে মনে করছেন। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, উন্নত দেশগুলিতে দূষণ নিয়ন্ত্রণে গণ পরিবহণের উপরে জোর দেওয়া হয়। কারণ, যত বেশি গাড়ি চলবে, তত বেশি জ্বালানি পুড়বে। বাতাসে বাড়বে কার্বনের পরিমাণ। “আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে দূষণ ঠেকাতে গণ পরিবহণে জোর দেওয়া আরও বেশি দরকার।”মন্তব্য এক পরিবেশ বিজ্ঞানীর। পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, কলকাতা শহরের মোট আয়তনের ৫-৭ শতাংশের মতো রাস্তা। সেখানে বেশি প্রাইভেট গাড়ি চললে যানজট যেমন হবে, দূষণও বাড়বে। ফলে পরিবহণ-কর্তাদের অনেকেই পরিবেশবিদদের এই মত মেনে নিয়েছেন।