বদল: টালিগঞ্জের প্রতিযোগিতায় ফুটবলে কিক্ মহিলাদের। (ডান দিকে) এক যুবককে শাড়ি পরায় উৎসাহ বাকিদের। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
মধ্যবয়সী পৃথুলা মহিলা ঘোমটা টেনে আলতা পরা খালি পায়ে এসে দাঁড়ালেন। ঠিক উল্টো দিকে কিছুটা দূরে ক্রিকেট-স্টাম্প। সম্ভবত জীবনে প্রথম বার মহিলার হাতে ক্রিকেট বল। সেটা ছুড়ে স্টাম্প ভাঙতে হবে। তাঁর আত্মীয়-প্রতিবেশী পুরুষদের মুখে ফিচেল হাসি। টুকরো মন্তব্যে ব্যঙ্গের খোঁচা। দর্শকদের মধ্যে থেকে কয়েক জন মহিলা উৎসাহ দিলেন, ‘‘প্রতিমাদি সোজা মারো। একদম লজ্জা পাবে না।’’
প্রতিমা ঘোষ মারলেন। এবং ডাইরেক্ট হিট! স্টাম্প ভূপতিত! হাততালির ঝড়। মাইকে উচ্চস্বরে তাঁর নাম। এত ক্ষণ খোঁচা মারা পুরুষদের দিকে এ বার পাল্টা ‘কেমন লাগল’ চোখে তাকিয়ে চেয়ারে বসলেন প্রতিমাদি।
রাষ্ট্রপুঞ্জের অর্থসাহায্যে লিঙ্গ-সাম্য সংক্রান্ত সচেতনতা কর্মসূচিকে অন্য রকম আঙ্গিকে সাজিয়েছে কলকাতার দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এই সচেতনতা কর্মসূচির টার্গেট গ্রুপ প্রধানত পুরুষেরা। আলোচনাসভা, পথসভা, ব্যানার-পোস্টার-মাইকিংয়ের মতো প্রথাগত সচেতনতা কর্মসূচির পাশাপাশি এই সব এলাকার পাড়ায়-পাড়ায় আয়োজিত হচ্ছে এক ছকভাঙা প্রতিযোগিতা। সেখানে ছেলে ও মেয়েদের ছাপ মারা ইভেন্টগুলিকে শুধু উল্টে দেওয়া হচ্ছে।
যেমন গত ৩০ নভেম্বর টালিগঞ্জে টিপু সুলতান মসজিদের উল্টোদিকের ইজাতুল্লাহ লেনের ভিতরে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় মহিলাদের বিষয় ছিল স্টাম্পে বল দিয়ে মারা এবং ফুটবলে শট মেরে গোলে ঢোকানো। আর ছেলেদের বিষয়, শাঁখে ফুঁ দেওয়া এবং শাড়ি পরা! আবার গত ৭ ডিসেম্বর পূর্ব পুঁটিয়ারির আনন্দপল্লিতে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় মেয়েদের বিষয়টাই বাঁধা আর ছেলেদের মশারি ভাঁজ করা। সোজা ব্যাখ্যায়— এটা শুধু ছেলেরা করতে পারেন, মেয়েদের দিয়ে হয় না আর ওটা মেয়েদের কাজ বলে সহজ, ছেলেরা অবলীলায় করে ফেলেন— এই বায়বীয় বিশ্বাসকে দুমরে দেওয়া। ‘মেয়েলি কাজ’ বলে কোনও কাজকে যেন স্টিরিওটাইপ করা না হয়, তার উপরেও জোর দেওয়া হচ্ছে। পাড়ার ছোট থেকে বড় সকলের ভিতর নারী-পুরুষের সম-ক্ষমতা ও সম-সম্মানের ধারণা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।
কর্মসূচির পরিচালকদের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ এখন ঘরোয়া হিংসায় দেশের মধ্যে এক নম্বর। এই অবস্থায় পরিবর্তনের চেষ্টা না করলে আর উপায় নেই। কর্মসূচির কো-অর্ডিনেটর পারমিতা চৌধুরীর ব্যাখ্যায়, যেহেতু অধিকাংশ পুরুষ নিজেদের ক্ষমতাধর ও উচ্চতর মনে করে বিপরীত লিঙ্গকে দমিয়ে রাখেন এবং লিঙ্গ-সাম্য ভাঙেন, তাই পুরুষের মানসিকতা না বদলালে কোনও প্রকৃত বদল আসতে পারে না। ইউনাইটেড নেশনস ট্রাস্ট ফান্ডের টাকায় এই সচেতনতা কর্মসূচির এলাকা হিসেবে বাছা হয়েছে কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বেশ কিছু নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত কলোনি এলাকাকে। যার মধ্যে পড়ছে কলকাতার ৮৯, ৯০, ৯৪, ১১৭, ১০৮, ১০৯ নম্বর ওয়ার্ড। নোনাডাঙা, মহাবীরতলা, যোধপুর পার্কের দু’টি বস্তি, পঞ্চাননতলা, সোনারপুরের সমুদপুর, বটতলা, বজবজ-২, বিষ্ণুপুর-২ ব্লক-এর মতো জায়গা। কাজ শুরু হয়েছে চলতি বছর এপ্রিল থেকে।
টালিগঞ্জের কে পি রায় লেনের মণীন্দ্রনাথ ঢালির কথায়, ‘‘দু’পয়সা রোজগার করছি বলে এতদিন মনে করতাম আমিই সংসারের সব। এখন এই সচেতনতা কর্মসূচিতে ঢুকে বুঝছি, মেয়েদের খাটনি কোনও অংশে কম নয়। বাড়ি আর বাড়ির লোকেদের ওরা না সামলালে আমরা বাইরে খাটতে পারতাম না।’’
একই কথা বলছিলেন কর্মসূচির অন্যতম দুই পরিচালক অঞ্চিতা ঘটক আর রাজা মেনন। ‘‘আমাদের দেশে বহু পুরুষ এখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, প্রতিদিন স্ত্রীকে মারা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। রাস্তায় মেয়েদের দুটো খারাপ কথা বলতে পারা মানে, হিরোগিরির অন্য নাম। পুরুষের এই মানসিকতা না-বদলালে মেয়েরা নিজেদের অধিকার নিয়ে শত চিৎকার করলেও কিছু হবে না।’’ পূর্ব পুঁটিয়ারির হরি শেঠ, মানস কাঞ্জিলালেরাও একই কথা বলছেন। তাঁদের এক জন বললেন, ‘‘আকছার বাড়িতে বলতাম, ‘তোমরা ছেলেদের কথার ভিতরে একদম কথা বলবে না’, ‘মেয়েদের মাথায় এ সব ঢুকবে না’ কিংবা ‘তোমাদের দিয়ে এই সব কাজ হবে না’। এ সব বলে ওদের অসম্মান করেছি। আমার ছেলে যাতে বড় হয়ে এই ভুল না-করে, সেটাই আমি ওকে শেখাব।’’ মেয়েদের ‘ফালতু’ আর ছেলেদের ‘সোনার আংটি’ ভাবা মনটাকে দিশা দিতেই তাই মেয়েদের পায়ে বল আর ছেলেদের হাতে শঙ্খ দেওয়া হল।