সচেতনতাই নেই, গভীর নলকূপ আটকাবে কে

রাস্তা থেকে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল একটানা ঘরঘর শব্দটা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ঢুকে পড়লেন বাইপাস সংলগ্ন বহুতলটিতে। শব্দের উৎস খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল রহস্যটা। পাম্প চালিয়ে গভীর নলকূপ থেকে জল তোলা হচ্ছে বহুতলটিতে।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৭ ০১:১৫
Share:

রাস্তা থেকে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল একটানা ঘরঘর শব্দটা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ঢুকে পড়লেন বাইপাস সংলগ্ন বহুতলটিতে। শব্দের উৎস খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল রহস্যটা। পাম্প চালিয়ে গভীর নলকূপ থেকে জল তোলা হচ্ছে বহুতলটিতে।

Advertisement

পুরসভার জলের সংযোগ আছে বটে, কিন্তু তাতে যে জলটা আসে তাতে আবাসনের ৫০টি ফ্ল্যাটের ১০ শতাংশেরও প্রয়োজন মেটে না। তাই সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা— নিয়ম করে পাম্প চলে। মাটির নীচ থেকে ওঠে জল। এক বাসিন্দা পরিষ্কার বলেই দিলেন, ‘‘পুরসভার সরবরাহ করা জলের স্বাদ ঠিক নেই। আর ওই জলের মানও সুবিধার নয়। তাই আমরা পাম্প চালিয়ে জল তুলি।’’

ওই বহুতলই শুধু নয়, উল্টোডাঙা থেকে গড়িয়া পর্যন্ত ইএম বাইপাসের দু’ধারে যে সব আবাসন রয়েছে তাদের অধিকাংশেরই পানীয় এবং অন্য ব্যবহারের জলের উৎস গভীর নলকূপ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সমীক্ষকেরা মহানগরীর জলস্তরের হাল নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। সমীক্ষক দলের এক সদস্য জানালেন, ‘‘শুধু বেসরকারি বহুতলই নয়, এমন সরকারি আবাসনও আমরা পেয়েছি যারা জল তুলছে ভূগর্ভ থেকে।’’

Advertisement

মহানগরীতে ভূগর্ভস্থ জলের অবস্থা নিয়ে কলকাতা পুরসভার তথ্যেই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ১৯৫৮ সাল থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে কলকাতার জলস্তর ৭ মিটার থেকে ১১ মিটার পর্যন্ত নেমেছে। পুরসভার এক আধিকারিকের মন্তব্য, কলকাতার ক্ষেত্রে সমস্যা মূলত দু’টি।

প্রথমত, ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত জল তোলা বন্ধ করা যাচ্ছে না। নিয়মের তোয়াক্কা না করে শহরের বহুতলগুলি গভীর নলকূপ ব্যবহার করে দেদার জল তুলেই যাচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিদর্শন করার মতো কর্মী নেই। আর কাউন্সিলরদেরও এ ব্যাপারে সচেতন করা যাচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, বৃষ্টির জল শহরের ভূস্তরে ফিরছে না। ভূ-বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কলকাতায় বৃষ্টির যে জল জমছে তার শতকরা ২০ ভাগও যাচ্ছে না মহানগরের ভূস্তরে। শতকরা ৮০ ভাগ জলই নষ্ট হচ্ছে। নবনির্মিত বহুতলগুলির নকশায় বৃষ্টির জল ভূস্তরে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রকল্প থাকতে হবে বলে একাধিক বার নির্দেশিকা জারি করেছে পুরসভা। কিন্তু তারা আইন করে এখনও তা বাধ্যতামূলক করতে পারেনি।

কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের এক কর্তার আক্ষেপ, ভূগর্ভের জলস্তরের ভারসাম্য রাখতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০৫ সালে একটি আইন করেছিল। সেই আইন কলকাতা পুরসভার ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। ওই আইনে ভূগর্ভের জল ব্যবহারের নির্দিষ্ট কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। শর্ত ভাঙলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। কলকাতার ভূগর্ভের জলস্তর বাঁচাতে অবিলম্বে কলকাতা পুরসভার ক্ষেত্রেও ওই আইনটি কার্যকর করার সুপারিশ করেছেন ভূ-জল পর্ষদের কর্তাটি।

কেন আইনটি কলকাতা পুরসভার ক্ষেত্রে বলবৎ করা হয়নি, তার ব্যাখ্যা মেলেনি কলকাতা পুর কর্তৃপক্ষের তরফে। পুরসভার এক আধিকারিক বলেন, ‘‘কলকাতার ভূগর্ভের জলস্তর যে কমছে, সে ব্যাপারে আমরা অবহিত। কী ভাবে তা রোধ করা যায়, তা নিয়ে আমাদের সর্বোচ্চ স্তরে আলোচনা চলছে।’’নলকূপ থেকে জল তোলা হচ্ছে বহুতলটিতে।

কলকাতার ভূস্তরের গঠনও ভূগর্ভস্থ জলের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। কলকাতা পুরসভার তথ্য বলছে, ট্যংরা-তপসিয়া এলাকায় যেমন কোবাল্ট এবং ক্রোমিয়ামের সমস্যা রয়েছে তেমনই বালিগঞ্জ, টালিগঞ্জ, তিলজলা, ঢাকুরিয়া, কসবা, সন্তোষপুর, গড়িয়া, বেহালা, ঠাকুরপুকুর এলাকা ডোবা, জলাশয়ের উপরে তৈরি হয়েছে। সেই সব ডোবা-জলাশয়গুলির মধ্যে যেমন যোগাযোগ রয়েছে, তেমনই নর্দমাগুলিও পরোক্ষভাবে সেই জলস্তরে গিয়ে মিশেছে। তাতে জলের মান খারাপ হয়ে গিয়েছে। ভাল জল পেতে গেলে অনেকটা নীচে যেতে হয়। এই সবের জন্যই কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তর সংরক্ষণে জোর দিয়েছেন সমীক্ষকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন