মুম্বই পারে, অনেকটা পেরেওছে। কিন্তু কলকাতা পারে না।
তাই, যে অপরাধে ধরা পড়লে মুম্বইয়ে গ্রেফতার ও বহু ক্ষেত্রে ছ’মাস জেল হয়, কলকাতায় তাতেই বেশির ভাগ সময়ে শাস্তি স্রেফ জরিমানা!
কড়াকড়ির এই ফারাকটাই পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে। মুম্বই পুলিশ এমন ব্যবস্থা নিয়েছে যে, মদ খাওয়ার পরে আর স্টিয়ারিং ধরার সাহসই করছেন না অনেকে। আর কলকাতায় মত্ত চালকেরা অনেকটাই নিশ্চিন্ত। তাঁরা জানেন যে, যতক্ষণ না দুর্ঘটনা ঘটছে, কোনও সমস্যা নেই। আর মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে ধরা পড়লেও বড়জোর হাজার দুই টাকা জরিমানা!
সোমবার সকালে দিল্লির জনকপুরিতে একটি সেডান গাড়ি কী ভাবে উল্টো রাস্তায় গিয়ে দু’জন পথচারীকে আক্ষরিক ভাবেই উড়িয়ে দিয়েছে, তার ভিডিও ফুটেজ এখন ভাইরাল। গাড়ি চালাচ্ছিল ঋষভ রাওয়াত নামে ২১ বছরের এক কলেজছাত্র। মদে সে এতটাই চুর ছিল যে, পুলিশ যখন গাড়িটি ধাওয়া করে তাকে পাকড়াও করে, তখনও সে ঠিক মতো দাঁড়িতে পারছিল না।
কলকাতার রেড রোডও এ বছর জানুয়ারি মাসে সাম্বিয়া সোহরাব নামে এক যুবকের এমন কীর্তির সাক্ষী থেকেছে। আবার তার পরের মাসে গড়িয়াহাট লাগোয়া বিজন সেতু দেখেছে কণিষ্ক মজুমদার নামে আর এক যুবকের একই রকম আচরণ। জুনের প্রথম সপ্তাহেও উল্টোডাঙায় এক সব্জি বিক্রেতাকে পিষে দিয়েছে মত্ত চালকের গাড়ি।
মদ্যপান করে কাউকে ধাক্কা মারলে বা দুর্ঘটনা ঘটালে চালককে গ্রেফতার করা হয়, তার হাজতবাস হয় ঠিক কথা। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটানোর বিষয়টি আসছে পরে, মদ্যপান করে গাড়ি চালানোই আইনত নিষিদ্ধ। যদিও কলকাতায় মদ খেয়ে গাড়ি বা মোটরবাইক চালানোর সময়ে ধরা পড়ে গেলে জরিমানা দিয়েই নিষ্কৃতি মেলে। আইন কার্যকর করার ব্যবস্থা এখানে তেমনই। মত্ত চালক ধরা পড়লে আইন ততটা কড়া নয়, যতটা কঠোর সে দুর্ঘটনা ঘটালে।
অথচ বাণিজ্যনগরী মুম্বই মত্ত চালকদের বিরুদ্ধে অনেকটাই কঠোর। মুম্বই পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মিলিন্দ রামভাউ ভারাম্বের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মত্ত অবস্থায় কেউ গাড়ি চালাতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স ছ’মাসের জন্য আটক করা হয়। সঙ্গে রয়েছে হাজতবাসের শাস্তি ও ২০০০ টাকা জরিমানাও। মিলিন্দ আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘এ বিষয়ে আমরা কোনও আপস করি না। যার জেরে মুম্বই শহরে এখন ‘হিট অ্যান্ড রান’-এর ঘটনা এক রকম ঘটে না বললেই চলে।’’
আর সেখানে কলকাতা পুলিশ জানাচ্ছে, মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে ধরা পড়লে মোটরযান আইনের ১৮৫ নম্বর ধারায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কী সেই ব্যবস্থা? পুলিশের বক্তব্য, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরে ২০০০ টাকা জরিমানা দিয়ে সেই লাইসেন্স ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেন চালক। কিন্তু এই ব্যবস্থায় আর্থিক জরিমানা ছাড়া চালকের মধ্যে অন্য ভয় ঢোকানো যাচ্ছে না।
২৬ জানুয়ারির কুচকাওয়াজের মহড়া চলাকালীন মত্ত সাম্বিয়া সোহরাব গাড়ি নিয়ে পুলিশের তিনটি ব্যারিকেড ভেঙে বেপরোয়া গতিতে ঢুকে পড়েছিল রেড রোডে। যার ফলে প্রাণ হারান বায়ুসেনার আধিকারিক অভিমন্যু গৌড়। তার এক মাসের মাথায়, ফ্রেব্রুয়ারিতেই বিজন সেতুর উপরে এক ফুটপাথবাসীকে পিষে দেয় বেপরোয়া গাড়ি। চালক কণিষ্ক মজুমদার মত্ত অবস্থায় ছিলেন বলে অভিযোগ। কলকাতার ঘুম ভাঙেনি তার পরেও। জুনের প্রথম সপ্তাহে, রাতের উল্টোডাঙার সিআইটি পার্কের পাশে বেপরোয়া গাড়ি পিষে দেয় ফুটপাথে শুয়ে থাকা হোসেন সর্দার নামে এক সব্জি-বিক্রেতাকে। চালক ইন্দ্রজিৎ সাধুখাঁও মত্ত অবস্থায় ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
মুম্বইয়ের প্রবাসী বাঙালিরা জানাচ্ছেন, রোজ রাতে বাণিজ্যনগরীর বিভিন্ন রাস্তায় নাকাবন্দি করে ব্রেথ অ্যানালাইজার দিয়ে গাড়ির চালকদের পরীক্ষা করে ট্রাফিক পুলিশ। রাত সাড়ে ন’টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তল্লাশি। মুম্বইবাসীদের অনেকেরই বক্তব্য— পরিস্থিতি এমনই যে, সপ্তাহান্তে বা অন্য সময়ে রাতে মদ্যপান করে পার্টিফেরতদের অনেকেই এখন আর গাড়ি চালানোর সাহস দেখাচ্ছেন না। দরকারে তাঁরা সার্ভিস সেন্টার থেকে চালক ডেকে নেন বা ওলা, উবের বুক করেন। মুম্বইয়ের বাসিন্দা ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে কর্মরত বিক্রমজিৎ রায় বলেন, ‘‘মুম্বই শহরের পুলিশ খুব কড়া। নেশা করে গাড়ি চালানোর সময়ে কেউ ধরা পড়লে তার আর রেহাই নেই।’’
গাড়ি থামিয়ে ব্রেথ অ্যানালাইজার দিয়ে চালকদের অবস্থা পরীক্ষা করে কলকাতা পুলিশও। ওই যন্ত্র বলে দেয়, রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা কতটা। ১০০ মিলিগ্রাম রক্তে ৩০ মিলিগ্রাম অ্যালকোহল মিললেই মত্ত বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু কলকাতার ২৫টি ট্রাফিক গার্ডের প্রতিটিতে রয়েছে মাত্র একটি করে ব্রেথ অ্যানালাইজার। এক-একটি গার্ডে অন্তত তিন-চারটি করে ওই যন্ত্র না থাকলে কোনও লাভ নেই বলে মেনে নিচ্ছেন পুলিশেরই একাংশ। যার ফলে কলকাতার বহু রাস্তায় মত্ত বেপরোয়া গাড়ি চালানো সত্ত্বেও পুলিশের দেখা মেলে না। কলকাতার ডিসি (ট্রাফিক) সলোমন নেসাকুমারের যুক্তি, ‘‘প্রয়োজনের তুলনায় পুলিশকর্মী কম থাকায় সর্বত্র সমান নজরদারি চালানো সম্ভব হয় না। তবে নতুন পুলিশকর্মী এলে সেই বুঝে পরিকল্পনা নেওয়া হবে।’’
পুলিশকর্তাদের একাংশ আর এক সমস্যার কথাও বলছেন। কলকাতায় মত্ত চালকেরা ধরা পড়লে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করে তাঁদের গাড়ি-সমেত ছেড়ে দেওয়া হয়। এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘গাড়িটাও সেই সময়ের জন্য বাজেয়াপ্ত করা উচিত। বা বলা উচিত, অন্য চালকের ব্যবস্থা করতে পারলে তবেই গাড়ি ছাড়া হবে। তা না হলে তো ওই মত্ত ব্যক্তি দুর্ঘটনা ঘটাতেই পারেন।’’